শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই: মোকতাদির চৌধুরী

আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ১২:৩৪

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। সাম্প্রদায়িক শক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর আসনের সংসদ সদস্য যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, বেসামরিক বিমান পরিবহন পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি র.আ.ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। 

শনিবার (২৭ মে) বিকালে সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত ‘মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সূতিকাগার। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামে হায়েনার মতো যে গণহত্যা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে যে সমস্ত অঞ্চলে জোড়ালো প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার অন্যতম পীঠস্থান হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কখনো সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। সারাদেশে যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনো এখানে সাম্প্রদায়িকতা স্থান পায়নি। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষকে কলুষিত করার জন্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শান্ত প্রিয় মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লেপে দেওয়ার জন্য একটি গোষ্ঠী সূক্ষ্মভাবে কাজ শুরু করে তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ২০১৬ সালে নাসির নগরে। এ শহরে শুরু হয় একজন ব্যবসায়ীর সাথে এক মাদ্রাসা ছাত্রের বাকবিতণ্ডা থেকেই। একেবারেই ব্যক্তিগত ঝগড়াকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেয়। এবং আমাদের এই শান্তির পরিবেশকে ঘোলাটে করা হয়। পরবর্তীতে একইভাবে নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চালানো হয়। নাসির নগরে কখনোই হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ছিল না। সেখানকার হিন্দু-মুসলিমরা পাশাপাশি থেকে এসেছেন আগে থেকেই। সেখানে সুপরিকল্পিত ভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণকে আপনারা সহজ ভাষায় নেবেন না।

তিনি বলেন, আপনারা হয়তো জানেন না কোনো একজন ব্যক্তিকে টার্গেট করার জন্য ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সেই ব্যক্তি কিন্তু নাসির নগরের না। ৪২ বছরে যে ব্যক্তির পা কখনো ওইদিকে পড়েনি তাকে সেখানে দায়ী করা হয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ। সেখানে আমরা স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেদিন হঠাৎ আমাকে জানানো হলো এখানে তাণ্ডব হচ্ছে আপনি আসবেননা। সেদিন পরিকল্পিতভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে আক্রমণ করা হয়েছিল। একই সাথে তারা রেল স্টেশন পুড়িয়ে দেয়। সেখানে আগুন নেভানোর জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে ফায়ার সার্ভিসের সাহায্যে আগুন নেভানো হয়। সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের এঘটনা পুরোটাই পরিকল্পিত।

কবি সুকান্তের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেমন মাথা নোয়াবার নয়। তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াও মাথা নোয়াবার নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অসাম্প্রদায়িক এতে কোনো সন্দেহ নাই। সাম্প্রদায়িক শক্তি এখানে কখনো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। তারা মাঝে মাঝে পরিস্থিতকে বিভ্রান্ত করতে পারে কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তারা কখনোই পুরোপুরি হাতে নিতে পারবে না। মুক্তি যুদ্ধের মাধ্যমে প্রমাণ করেছ যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অসাম্প্রদায়িক একটি স্থান।

সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন

অনুষ্ঠানে সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ ব্যাপক ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। জানা যায়, সারা বাংলাদেশে খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৬০০ জন তার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৫৬ জন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এবং শহীদের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসাম্প্রদায়িক তাতে বোঝা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ আগে থেকেই কতটা অসাম্প্রদায়িক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটিতে কখনোই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দেশভাগের সময় ব্রিটিশরা এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করেছিল। সে দাঙ্গা থামানোর জন্য বঙ্গবন্ধু আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সেই ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা নোয়াখালী ছাড়াও অনেক এলাকায় ছাড়িয়েছিল কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সে সময়ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে স্পর্শ করতে পারেনি।  কিন্তু আমরা গত কয়েক বছর যাবত দেখছি যে পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী আমাদের শান্তির মধ্যে দাঙ্গা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। 

তিনি বলেন, যারা অসাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে আপনারা আমরা সকলে যদি রুখে দাঁড়াই, সকলে যদি সচেতন থাকি তাহলে অন্তত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়বে না। এর আগে আমাদের দেশে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা নিয়ে দেশের অনেক জায়গায় দ্যাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছিল কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কোনো মন্দিরে একতা আঁচরও লাগেনি। এতেই বোঝা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আগে থেকেই কতটা অ সাম্প্রদায়িক।

তিনি আরও বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে রাষ্ট্রীয়ভাবে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া' নামে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আমরা অবশ্যই অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো। এখানে অবশ্যই দাঙ্গা থাকবে না, অসাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে সারা দেশের মধ্যে আমরা মাথা উঁচু করে থাকবো।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াহিদ খান লাভলু, জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল বারী চৌধুরী মন্টু, সাহিত্য একাডেমির পরিচালক ম-লীর সদস্য নন্দিতা গুহ। স্বাগত বক্তব্য দেন সাহিত্য একাডেমির সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে নাসিরনগর উপজেলার চৈয়ারকুড়ি থেকে আগত সালাহউদ্দিন মুকুলের নেতৃত্বে জারু মিয়া ও অমিয় ঠাকুরের সংগঠন বাউল গান পরিবেশন করেন। এছাড়াও সাহিত্য একাডেমি, তিতাস আবৃত্তি সংগঠন ও ভাষা ও সাহিত্য অনুশীলন কেন্দ্র বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে।  একক আবুত্তি করেন মনির হোসেন।  অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নুসরাত জাহান বুশরা।

ইত্তেফাক/এএইচপি