গর্ভকালীন ১৯ সপ্তাহে অ্যাবরশন হয় কাকলীর। হাই ব্লাডপ্রেশার বাচ্চার ওজন কম, মায়ের ওজন বেশি, এমন জটিলতা ছিল তার। গত রাতে (বৃহস্পতিবার) তার রক্তপাত শুরু হয়। তিনি ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন। রক্তে হিমোগ্লোবিন ৩ নিয়ে চাঁদপুর থেকে এসেছেন তানিয়া। তার রক্তস্বল্পতাও আছে। একজন গর্ভবতী মায়ের হিমোগ্লোবিন কমপেক্ষ ১০ থাকার কথা। চার বার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মা হয়েছেন গোপালগঞ্জের সীমা, তার বয়স ৩৭ বছর। পঞ্চম বারের মতো ৩০ সপ্তাহে গর্ভবতী সীমার আলট্রাসনোগ্রামে ২৬ সপ্তাহ গর্ভবতী দেখা যাচ্ছে। তার বাচ্চার ওজন অনেক কম—এমন উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন মায়েরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এই হাসপাতাল দেশের অন্যতম ‘টারশিয়ারি হাসপাতাল’। যেখানে দেশের যে কোনো অঞ্চল থেকে জটিল রোগী পাঠানো হয়, সরকারি এই হাসপাতাল তাদের ফিরিয়ে দেয় না, চিকিৎসা করে। এই হাসপাতালে আছে ‘ফিটো ম্যাটারনাল মেডিসিন ইউনিট’ বা উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন গর্ভবতী রোগীদের ওয়ার্ড। সপ্তাহে দুই থেকে চার জন রোগী গর্ভকালীন জটিলতা নিয়ে মারা যান। এমন বাস্তবতার মধ্যে আজ ২৮ মে ‘গর্ভকালে চার বার সেবা গ্রহণ করি, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’ প্রতিপাদ্য করে দেশ জুড়ে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস।
- চার বার সেবা গ্রহণ না করায় যত জটিলতা
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ডিএমসিএইচ) হাসপাতালে ‘ফিটো ম্যাটারনাল মেডিসিন ইউনিট বা উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন গর্ভবতী রোগীদের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, এখানে প্রতিটি বেডেই রোগী আছে। তাদের একজন সীমা (৩৭ ) জানান, তিনি গর্ভবতী হওয়ার শুরুতে এক বার আর ৩০ সপ্তাহে জটিল পরিস্থিতিতে পড়ার সময় অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপ ও বাচ্চার ওজন কম অনুভূত হওয়ায় আরেক বার চিকিৎসকের কাছে যান। শুরুতে চিকিৎসক তাকে সবকিছু ঠিক আছে বলে জানান। চারটি শিশু সিজার হওয়ার পর কেন আবার বাচ্চা নিলেন, এই অবস্থায় আবার কীভাবে অপারেশন হবে—প্রশ্ন করা হলে সীমা বলেন, তারা ইচ্ছে করে আবার বাচ্চা নেননি, অসচেতনতার কারণে হয়ে গেছে। এই ওয়ার্ডের ৪ নম্বর বেডে আছেন ৩০ সপ্তাহের গর্ভবতী সুমি। তিনি উচ্চ রক্তচাপ ও পানি ভেঙে যাওয়া সমস্যা নিয়ে আসেন। তিনিও এক বার চেকআপ করান।
- বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
ডিএমসিএইচের স্ত্রী রোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফাতেমা রহমান ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিদিন এখানে ৬০ থেকে ৮০ জন রোগী সারা দেশ থেকে এসে ভর্তি হন। এরা সবাই কোনো না কোনোভাবে জটিল পরিস্থিতি নিয়েই আসেন। তাদের মধ্যে ২০-২৫ জনের অবস্থা বেশি গুরুতর থাকে। এখানে যে শুধু প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাধারণ রোগীরা আসেন তা নয়, বেসরকারি নামিদামি হাসপাতালের গুরুতর রোগীদের এখানে পাঠানো হয়। একলামশিয়া বা উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি, রক্তক্ষরণ, রক্তশূন্যতা, গর্ভবতী মায়ের হূদেরাগ, কিডনি রোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, বহুবার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মা হওয়াসহ অনেক জটিল অবস্থায় রোগী আসেন। এই সমস্যাগুলো যখন একজন শিশু মায়ের হয় তখন তার জটিলতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ৭০-৮০ জন রোগীর মধ্যে ২০ জন থাকেন, তারা প্রথম বার মা হচ্ছেন ১৮ বছর বয়সের আগে। আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি না। তবে চাহিদা অনুযায়ী অনেক সময় হয়তো আইসিইউ—এজাতীয় সেবাগুলো শয্যার অভাবে দেওয়া যায় না। এমন জটিল মায়েরা যখন ঠিক সময়মতো আসতে পারে না, আমরা তাদের সঠিক চিকিৎসা দিতে পারি না, তখন মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, মাসে গর্ভকালীন জটিলতা নিয়ে তিন থেকে চার জন রোগী মারা যান।
- ব্যবস্থা হচ্ছে আরো আধুনিক চিকিৎসার
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক ইত্তেফাককে বলেন, আমাদের ২ হাজার ৬০০ বেডে আজকে রোগী আছে ৩ হাজার ৮০০। প্রতিদিন সারা দেশ ও ঢাকা থেকে রেফার করা ১৫ থকে ২০টি গুরুতর জটিল (গর্ভবতী মা) রোগীর অস্ত্রোপচার হয় এখানে। তিনি বলেন, কোনো সপ্তাহে দুই থেকে চার জন গর্ভকালীন জটিলতায় নিয়ে আসা রোগী মারা যান।
আইসিইউর সমমানের সেবা দেওয়ার মতো আমাদের চারটি ডিভিশন আছে। তার পরও রোগীর চাহিদার তুলনায় কম। আমাদের ৫২টি আইসিইউ ও ৩৮ এনআইসিইউ (শিশুর আইসিইউ) আছে। ১০ বেডের একটি অত্যাধুনিক আইসিইউ এক মাসের মধ্যে চালু হবে বলে জানান তিনি।