সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সেফটি ফার্স্ট নীতি মানিয়া চলিতে এই উদাসীনতা কেন? 

আপডেট : ৩১ মে ২০২৩, ০০:১৫

আবারও খবরের শিরোনামে রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। গত বৎসরের ১৫ আগস্ট উত্তরায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ক্রেন ভাঙিয়া গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারে থাকা দুই পরিবারের পাঁচ যাত্রী নিহত হন। ইহা লইয়া দেশ জুড়িয়া শুরু হয় তুমুল সমালোচনা। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করিয়া কীভাবে এইরূপ ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণকাজ চলিতে পারে? এইবার আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের বুঝাইয়া দিল এই ব্যাপারে আমরা কতটা উদাসীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। গত সোমবার মহাখালী ফ্লাইওভারের উপর নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হইতে এক ফুটেরও অধিক লম্বা একটি রড ছিটকাইয়া পড়িয়া মাথায় ঢুকিয়া গেলে নিহত হয় এক কিশোর। এই রডটি তাহার মাথার একপাশ দিয়া ঢুকিয়া অন্যপাশ দিয়া বাহির হইয়া যায়। কী লোমহর্ষক ঘটনা! কিশোরটি সেই সময় তাহার নিচ দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছিল। মূলত কাজের সাইটে নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। নির্মাণকাজের সময় পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না থাকাটাকে আমরা আজ যেন কিছুই মনে করিতেছি না। নির্মাণকাজে এইরূপ নিরাপত্তাহীনতা আর কতদিন ধরিয়া চলিতে থাকিবে?

বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে রহিয়াছে। এই দেশে সাম্প্রতিক কালে গ্রহণ করা হইয়াছে বহু উন্নয়ন প্রকল্প। রহিয়াছে মেগা প্রকল্পও। দেশব্যাপী বড় বড় সেতু, টানেল, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নযজ্ঞ চলিতেছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এই সকল প্রকল্প আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু এই সকল প্রকল্পের অনেক ক্ষেত্রে দুইটি সাধারণ সমস্যা পরিলক্ষিত হইতেছে। এক. মেয়াদ ও দফায় দফায় ব্যয়বৃদ্ধি এবং দুই. বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগ ও নিরাপত্তাহীনতা। নির্মাণকাজে সেফটি ফার্স্ট বা নিরাপত্তাই প্রথম নীতি অবলম্বন করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে; কিন্তু আমাদের দেশে নির্মাণাধীন প্রকল্পে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় শ্রমিকরা যেমন মারা যাইতেছেন, তেমনি পথচারী বা পরিবহন যাত্রীরাও দুর্ঘটনা হইতে রেহাই পাইতেছেন না। অথচ ইমরাত নির্মাণ আইন-১৯৫২, জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬, ঢাকা মহানগর ইমরাত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ প্রভৃতি আইন ও বিধানের কোনো ঘাটতি নাই। ইহা ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে যে, যে কোনো ভবন নির্মাণের সময় চারিপার্শ্বে নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হইবে। উঁচু স্থানে কাজ করিবার সময় লিফট, সেফটি বেল্ট, শক্ত দড়ি-মাচা ব্যবহার করিতে হইবে। কাজের সময় শ্রমিকদের হেলমেট, পায়ে গামবুট ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করিতে হইবে। বিদ্যুতের তারের নিকট ভেজা রড উঠানো-নামানো যাইবে না ইত্যাদি। 

মেট্রোরেলের ক্ষেত্রে আমরা দেখিয়াছি, সড়কে যথাসম্ভব নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়া তাহারা কাজ শুরু করিয়াছেন; কিন্তু বিআরটি প্রকল্পে এই বিষয়টি কেন অবহেলিত? এই অবহেলার জন্য গাজীপুর, উত্তরা, মহাখালী অংশে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটিয়া যাইতেছে। যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের শুরুতেই নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। ব্যস্ততম সড়কের উভয় পার্শ্ব দিয়া হাজার হাজার যানবাহন রাস্তার মধ্যখানে রাখা ক্রেন, গার্ডার, স্ল্যাব, কংক্রিটের ব্লক ও অন্যান্য মালামাল ঘেঁষিয়া কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে দিনের পর দিন? সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার যদি নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি বারংবার লঙ্ঘন করিতে থাকেন, তাহা হইলে কেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এই সকল প্রকল্প চুক্তির মধ্যেই থাকে যে, ঠিকাদার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ইস্যুগুলি নিশ্চিত করিয়াই কাজ শুরু করিবেন। সেইগুলি আবার নিশ্চিত করিবার জন্য আছেন কনসালট্যান্ট, আছেন প্রজেক্ট পারসন। সেফটি মেজারমেন্টগুলি তাহাদের যাচাই করিয়া দেখিবার কথা। ইহা ছাড়া প্রজেক্টের মধ্যে আলাদা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন ইউনিট থাকে। থাকেন দাতা সংস্থার কনসালট্যান্টও। তাহারা এই সকল মনিটরিং করেন না কেন, ইহাই বড় প্রশ্ন।

অতএব, নির্মাণকাজের সময় শ্রমিক ও পথচারী-যাত্রীদের নিরাপত্তাহীনতায় রাখিয়া কোনো কাজ চলিতে পারে না। এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। নৈতিকতা ও মানবিকতার দিক হইতেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। সকল সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে এই নিরাপত্তাহীনতা দূরীকরণে কর্তৃপক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন