মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

শতবর্ষ আগের মুক্তবুদ্ধির মনীষী

আপডেট : ০৪ জুন ২০২৩, ২০:৫২

‘হারিয়ে যাওয়া মনীষা মহম্মদ এছহাক বি.এ. রচনা সংগ্রহ’— গ্রন্থের নামকরণেই স্পষ্ট হচ্ছে— লেখক মহম্মদ এছহাক একজন বিস্মৃত পুরুষ। সাধারণভাবে একথা বলাই যায়, যত লেখক আত্মপ্রকাশ করেন, নির্মম ও নির্মোহ কালের বিচারে তাঁদের অধিকাংশই হারিয়ে যাবেন এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লেখক মহম্মদ এছহাক-এর যে পরিচয় ইতিমধ্যে পেয়েছি, তাঁর লেখায় যে উজ্জ্বল আলোর ঝলক দেখেছি, তাতে তাঁকে অচিরেই হারিয়ে যাবার মতো ক্ষীণপ্রভা মনে হয়নি। ইতিহাস থেকে এমন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের অসময়োচিত অন্তর্ধান কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর প্রবন্ধগুলো আমাদের সাহিত্যের এক অত্যুজ্জ্বল সম্পদ। ‘সুখ বনাম দুঃখ’, ‘অদৃষ্ট’, ‘মানুষ’, ‘মৃত্যু ও জীবাত্মা’, ‘স্বপ্ন-রহস্য’— প্রবন্ধের এসব নামকরণ থেকে তাঁর চিন্তার জগতের যে আভাস মেলে তা অত্যন্ত গভীর, বিশাল ও অর্থময়।

মহম্মদ এছহাক-এর নাতি আলী আকবর টাবী আলোচ্য গ্রন্থটির সম্পাদক। সম্পাদকের বর্ণনামতে মহম্মদ এছহাক ১৯০০ বা ১৯০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং নাতিদীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন যাপন করে ১৯৫৩ বা ১৯৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচনায় বিজ্ঞান ও দর্শন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। তাঁর প্রবন্ধে অবলীলায় ভিড় করেছে ট্রাইন, মেটালিঙ্ক, সি ডব্লিউ লিড বিটার, ডারউইন, এ কোনান ডয়েল, স্যার অলিভার লজ, স্টিফেন্স, এন্ড্রু ল্যাঙ, ডা. এফ জি লি প্রমুখ মনীষীর চিন্তাভাবনা। আশ্চর্য ব্যাপার তিনি শুধু বিজ্ঞান ও দর্শন ভিত্তিক প্রবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত হননি, গল্প রচনা করেও এই বিজ্ঞান ও দর্শনকে পরস্ফুিট করেছেন। বিশ্বসাহিত্য থেকে বাছাই করা গল্প অনুবাদ করেও তাঁর দর্শনের অনুকূলে সমর্থন জুুগিয়েছেন।

স্মরণ রাখা প্রয়োজন, মহম্মদ এছহাক-এর আবির্ভাব বিংশ শতকের শুরুতে। তখনো বাঙালি মুসলমানসমাজ ছিল মূলত বিজ্ঞানবিমুখ, আর তাঁদের দর্শনচর্চা ছিল অনেকটা মুসলিম দর্শন বিশেষ করে ধর্মীয় দর্শনচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরকম একটি সময়ে একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে তিনি বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরেন এবং জীবন-জিজ্ঞাসার জবাবে ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনের নিক্তি ব্যবহার করতে থাকেন। তাঁর এই প্রয়াস ছিল আমাদের মুসলিম বাংলা সাহিত্যে অনেকটা নতুন, অনেকটা অভিনব। নিঃসেন্দহে এই ধারার সাহিত্যচর্চায় বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনি একজন প্রথম সারির পথিকৃত্। তিনি আমাদের মাঝে যুক্তি প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক নতুন দরজা উন্মোচন করেছিলেন।

কর্মজীবনে মহম্মদ এছহাক ছিলেন একজন শিক্ষক। তাঁর ‘মানুষ’ প্রবন্ধটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাট্রিকুলেশন ক্লাসের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সে আমলের কোনো মুসলমান লেখকের জন্য এটা এক বিরাট সম্মান ও স্বীকৃতি। এখন প্রশ্ন, যে লেখক তাঁর মোটামুটি যৌবনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করেন, সাতচল্লিশ-উত্তর পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে তিনি অজ্ঞাত ও অবহেলিত থাকেন কী করে? এ লজ্জা কার?

অধুনা দুষ্প্রাপ্য তত্কালীন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে এ মনীষীর হীরকোজ্জ্বল রচনাসম্ভারকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সমুদয় উদ্যোগ আয়োজনের জন্য আলী আকবর টাবীকে অভিনন্দন জানাই। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থের যশস্বী লেখক মোহাম্মদ হাননান এই গ্রন্থের একটি মূল্যবান ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। তাঁকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

বইটি প্রকাশ করেছে দ্যু প্রকাশন, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। ২৭২ পৃষ্ঠার এই বইটির মুদ্রিত মূল্য ৫০০ টাকা।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন