রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ২৮ মে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। বিরোধীরা জোট বেঁধেও তার এই জয় ঠেকিয়ে দিতে পারেনি। তারা আশা করেছিল, এর মধ্য দিয়ে এরদোয়ানের দুই দশকের শাসনের অবসান ঘটানো যাবে। তারা মনে মনে এরদোয়ানের সময় দুর্নীতি লাগামহীনভাবে বেড়েছে। বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব। সেই সঙ্গে কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া প্রলংকরী ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্তিতি তার প্রশাসন ঠিকমতো সামাল দিতে পারেনি বলেও তারা মনে করে।
ফেব্রুয়ারির ঐ ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের ওপরে মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। অনেকে ধারণা করেছিল, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। সময়মতোই নির্বাচন হয়েছে। এত বড় একটি ভূমিকম্পের ঠিক তিন মাসের মাথায় নির্বাচন আয়োজন করা সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তবে এরদোয়ান একে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন। পশ্চিমা গণমাধ্যম সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধীদের সহায়তা করেছে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠ উভয় পক্ষের জন্য সমান নয়। দেশটির টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ বিরোধী প্রার্থী কামাল কিলিকদারোগ্লুকে নির্বাচনি প্রচারণা চালানোর সুযোগ দেয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছিল। অন্যদিকে এরদোয়ান রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পুরোদমে নিজের প্রচারণার কাজে ব্যবহার করেছেন। বিরোধীরা রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র ব্যহারের সুযোগ পায়নি।
এরদোয়ানের শাসনব্যবস্থায় নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি একজন জনপ্রিয় একনায়ক। দুর্নীতি বা অন্যান্য অভিযোগ সত্ত্বেও গত দুই দশক যাবত্ তুরস্কের অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশটির একটি শক্তিশালী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে তিনি মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেন। এটি তার নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকে মনে করেন। সাধারণ ভোটারদের কাছে এ সময় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়ে থাকতে পারে। কিলিকদারোগ্লু নিজেকে যেভাবে পশ্চিমাপন্থি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেটি ভোটের রাজনীতিতে তার বিপক্ষে গেছে। কারণ সাধারণ ভোটারদের অনেকে চায়নি তুরস্ক কোনো একটি পক্ষে ঢুকে পড়ুক। কামাল আতাতুর্কের সময় এবং তারপর দীর্ঘ সময় দেশটি পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল।
এরদোয়ান সেখান থেকে তার দেশকে বের করে এনে একটি নতুন পরিচয়ে দাঁড় করিয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধ ছাড়াও তুরস্ককে যে যুদ্ধ সরাসরি প্রভাবিত করেছে সেটি হলো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। বলা যায়, মেয়াদের অর্ধেক সময় সিরিয়া যুদ্ধসহ আরব বসন্তের ঝাঁপটা সামলাতে হয়েছে এরদোয়ানকে। তুরস্কের অন্যতম অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটের মূলে আছে জাতি কুর্দিরা। এরা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে আছে এবং একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করছে। তারা একটি দেশ গঠন করলে তুরস্কের অখণ্ডতা খর্ব হবে। এরদোয়ান সরকার কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে দমনাভিযান চালিয়ে পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। এমনকি তুর্কি সেনাবাহিনী ইরাকের ভেতরে ঢুকেও অভিযান চালিয়েছে। নির্বাচনি প্রচারাভিযানকালে এরদোয়ান কিলিকদারোগ্লুকে কুর্দি বিদ্রোহী গ্রুপ পি কে কের মিত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, কিলিকদারোগ্লুর প্রেসিডেন্ট হলে কারাবন্দি কুর্দি নেতা আব্দুল্লাহ ওজালান মুক্তি পাবেন। পর্যবেক্ষকেরা অবশ্য এরদোয়ানের এসব কথাকে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ কিলিকদারোগ্লুর সঙ্গে পিকেকের সরাসরি সম্পর্ক নাই। যাই হোক, বিরোধীদের অভিযোগ, আতঙ্ক ছড়িয়ে এরদোয়ান নির্বাচনি মাঠে ফায়দা লুটেছেন।
তুর্কি রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু শরণার্থী। সিরিয়া, ইরাক ও আফগান যুদ্ধের জের হিসেবে তুরস্ককে এখন লাখ সিরীয়, কুর্দি ও অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের বহন করে চলেছে। শরণার্থীরা সরকারের বিভিন্ন ত্রাণসহায়তা পাচ্ছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর তারা চাপ সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। বিরোধীরা এর জন্য এরদোয়ানের উন্মুক্ত দুয়ার নীতিকে দায়ী করেছে। তবে সাধারণ মানুষ এমন ধারণাও পোষণ করে যে শরণার্থী সংকট নিরসনে এরদোয়ানই উপযুক্ত লোক।
তুরস্ক অনেক দিন ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ধুঁকছে। মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যে তিন অঙ্কের ঘর স্পর্শ করেছে। তুর্কির মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে চলেছে। বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে হু হু করে। যদিও এসব সমস্যার জন্য এরদোয়ান সরকারের অনুসৃত নীতিকে দায়ী করা যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষ মনে করে, এই সংকট থেকে উত্তরণে তিনি যথোপযুক্ত ভূমিকা রাখতে পারেন। যে দলটি দশকের পর দশক ক্ষমতার বাইরে ছিল, তাদের এই সময় তারা ক্ষমতায় আনতে চায়নি। তাছাড়া বেকারেরা সরকারের কাছ থেকে যেসব সুবিধা ভোগ করে আসছিল, কিলিকদারোগ্লু ক্ষমতায় এলে তারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। এসব কারণে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে থাকলেও এরদোয়ান স্বপদে বহাল থাকতে পেরেছেন।