সর্বদা কর নিয়ে আমাদের অস্বস্তি থাকে। কর নিয়ে অস্বস্তি দুই রকমের। অস্বস্তি সরকারের ও বিদেশিদের কত বেশি কর তোলা যায় ও কত বেশি ঋণ শোধ করা যায় এই দুই রকম অস্বস্তিই সিস্টেমের মধ্যে আছে। তাই সরকার কর সপ্তাহ চালু করেছেন, টকশোতে হইচই করে বলছেন এবার আমরা পর্যাপ্ত কর সংগ্রহ করব, ইত্যাদি।
কোনো এক কর সপ্তাহে রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে টিভি, টকশোতে আমার দেখা হয়েছিল। তাকে আমি তখন দুটো কথা বলেছিলাম। প্রথমত, মোট জিডিপির খুব সামান্য অংশই আমাদের সরকার রাজস্ব আয় হিসাবে সংগ্রহ করে থাকেন। বহু বছর ধরে এটা সমগ্র জিডিপির ১০-১২ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করছে। অথচ তুলনীয় অনেক দেশ জিডিপির ১৫-২৫ শতাংশ রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে। আমাদের রাজস্ব জিডিপির অনুপাত আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি একমত হয়েছিলেন। স্বভাবতই আমরা যদি কল্যাণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করতে চাই (যেমনটি রয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে) তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা, শিক্ষানিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যনিরাপত্তাকে বাজার বা ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে এসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরিপূরক দায়িত্ব যথাসম্ভব সরকার বা রাষ্ট্রকে নিতে হবে। বিশেষত, নিচের ‘ম্লান-মূঢ়-মূক’ জনগণের জন্য তা না নিলেই নয়।
যদি তা-ই হয়, তাহলে সরকারের হাতে বিপুল আর্থিক সম্পদ থাকতে হবে। নিওলিবারেল দাতাগোষ্ঠী এই অর্থের জোগান আদর্শগত কারণেই দেবেন না। সুতরাং নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ অভিযান ত্বরান্বিত করা ছাড়া জনগণের ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বপ্নের বাস্তবায়ন অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সম্পদ সংগ্রহ করবেন কোথা থেকে? বলা হয়, এমনিতেই আমরা স্বল্প আয়ের দেশ, আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকেরই কর প্রদানের সক্ষমতা নেই। সুতরাং সরকারের আয়-ভিত্তি অত্যন্ত সংকুচিত ও অগভীর। কথাটা কি আসলেই সঠিক? আমাদের দেশে এমন অনেক ধনী লোক আছেন, যারা ইতিমধ্যেই ‘বিলিওনিয়ার’ বা শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। যারা খুবই প্রাচুর্যময় ও বিলাসী জীবন যাপন করেন। ইউরোপ সম্পর্কে বলা হয়, সে মহাদেশের বার্ষিক সুগন্ধির খরচ দিয়ে সারা পৃথিবীর চরম দরিদ্রদের এক বছরের মৌলিক চাহিদাসমুহ পূরণ করা সম্ভব। সাম্প্রতিক এক বিশ্ব জরিপে জানা গেছে, পৃথিবীতে অপুষ্টিতে ভোগা শীর্ণ লোকের তুলনায় অতিভোজনে কষ্ট পাচ্ছেন, এরকম স্থূলকায় লোকের সংখ্যা বেশি! পৃথিবীতে যেমন দেখা যাচ্ছে সম্পদের অভাব বা সক্ষমতার অভাব সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে সম্পদ বণ্টন ও ব্যবহারের বৈষম্য। প্রায় একই রকম কথা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও খাটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রতি বছর আয় ও সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কথা ঠিক, সমগ্র জনসংখ্যায় দরিদ্রদের আপেক্ষিক অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ধনী-দরিদ্রের আয় ব্যবধান হ্রাস তো পায়ইনি, বরং ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। নিচের তালিকায় প্রাসঙ্গিক তথ্যগুলি তুলে ধরা হলো :
ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের প্রবণতা
উৎস : বিবিএস খানা আয়-ব্যয় জরিপ, বিভিন্ন বত্সরের তথ্য।
সুতরাং করভিত্তি করযোগ্য লোকের নিরিখে সংকুচিত হয়নি বরং প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের করনীতি রাঘববোয়ালদের টার্গেট না করে সাধারণ স্বল্প বিত্তের মানুষকেই টার্গেট করছে বেশি। আমাদের মোট করের ৭০-৭৫ ভাগ আসে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে। এই অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা বহন করে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব মানুষ তথা ক্রেতাগোষ্ঠী। এদিক দিয়েও আমি রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম, ২০০০-০৬ কাল পর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি নিম্ন আয়ের দেশে প্রত্যক্ষ করের অনুপাত গড়ে ছিল প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ শতাংশ। নিঃসন্দেহে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই গড় পারফরম্যান্সের তুলনায় এখনো পিছিয়ে আছি। সুতরাং আমাদের কর বৃদ্ধির প্রধান টার্গেট হওয়া উচিত প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধি। এমনভাবে কর বৃদ্ধি করতে হবে, যা নিশ্চিতভাবে ধনী ও সামর্থবান লোকদের ওপর বর্তায়। এ ব্যাপারেও রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। উপরন্ত তিনি বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের নীতিও নাকি তা-ই। উদাহরণ হিসাবে বলেছিলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সম্পদ এবং আয়কর বৃদ্ধির একটি নতুন প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদের কাছে পাঠিয়েছেন, যা এখনো বিবেচনাধীন আছে।
সংবাদপত্রে এই তথ্য ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রত্যক্ষ কর প্রদানে উত্সাহ সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্ণধাররা (প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী) এখন থেকে আয়কর প্রদান করবেন। কিন্তু এ নিয়ে একটা বিচিত্র দোদুল্যমানতা তখন লক্ষ করা গিয়েছিল। প্রথমে শক্তিমানেরা করপ্রদানে সম্মত হলেন, পরে জানা গেল এনবিআর কর্তৃক প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়নি বলে তা এ বছর এই উদ্যোগ কার্যকর হবে না। আরো পরে যখন প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেন তখন দেখা গেল, তিনি নিজে কর প্রদানের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত বদলে গেল এবং সিদ্ধান্তটি নতুন করে পুনরায় কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হলো। কথায় বলে, সব ভালো যার শেষ ভালো। কিন্তু আমাদের শাসনব্যবস্থার অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে, শেষ ভালোটা শেষ পর্যন্ত এসে প্রধানমন্ত্রীর একক সদিচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এক ব্যক্তিনির্ভরতা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কখনোই কাম্য নয়। এটা কর্তৃত্বপরায়ণ গণতন্ত্র।
আমি রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আরো বলেছিলাম, আমাদের সংবিধান অনুপার্জিত আয়ের ভোগ অনুমোদন দেয় না। আর আপনারা কয়েক বছর কর ব্যবস্থায় কালো টাকাকে অনুমোদন দিয়েছেন—এটা কি সংবিধানবিরোধী হচ্ছে না? হিম্মত থাকলে শেয়ার কেলেঙ্কারি, চোরাচালান, অস্ত্র ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে যারা প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছেন, তাদের সেই অনুপার্জিত আয়ের ওপর বর্ধিত হারে কর আরোপ করুন! তাদের দৃষ্টিকটু ভোগের অবসান ঘটান। এতে দেশে অসাম্য কমবে। সরকারের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি আরো সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে এবং দেশে গড়ে উঠবে উত্পাদনশীল সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক অঙ্গীকার। এ ব্যাপারেও তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু আমি আরো বলেছিলাম রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এটা সম্ভব নয়। টিভির পর্দায় সেদিন তিনি অবশ্য দাবি করেছিলেন যে, এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা বা রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে।
কিন্তু অন্য সব কথা ছেড়ে দিলেও বর্তমানে আমার প্রশ্ন সরকারের এই তথাকথিত অঙ্গীকার কি এতই দুর্বল যে, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া রাজস্ব বোর্ড সামান্য একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করে থাকে—দোদুল্যমান হয়। নাকি এটা সরকারি কর্মচারীদের স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপ। সময় হয়েছে, স্বাধীন বিবেচনা অনুযায়ী, সরকারের ঘোষিত প্রতিশ্রুতি মোতাবেক এবং নিজস্ব বিবেক অনুযায়ী জনপ্রশাসনকে সচল করা। বেতন বা আয় সরকারি মধ্য পর্যায়ের বা সত্ উচ্চপর্যায়ের কর্মচারীদের কম হতে পারে, কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসাবে নির্ভীক নীতিনিষ্ঠতা তারা কেউ কেউ নিশ্চয়ই দেখাবেন এই প্রত্যাশা রেখে আজকের লেখাটি এখানেই হয়তো শেষ করা উচিত। কিন্তু রাজনীতি তো একটি গতিশীল বিষয়। আমার এই লেখার বক্তব্য অতীতে যেমন প্রসঙ্গিক ছিল, এখনো ঠিক তেমনি প্রসঙ্গিক। শুধু প্রাসঙ্গিক বললে কম বলা হবে, বরং বলতে হয় ইস্যুটি এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে যে, এতদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন এই মুহূর্তে আইএমএর ঋণ নেওয়ার পর সরকার তার বকেয়া কাজগুলো অপমানিতভাবে এবং বাধ্য হয়ে শুরু করবে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও এখন ভাবছেন ও বলছেন ‘আমেরিকা তাকে ক্ষমতায় রাখতে চায় না’। কিন্তু এখন এ কথা বলে লাভ কী? যখন নিওলিবারাল পথ ধরে অর্থনীতির ‘অগ্রযাত্রা’ শুরু হয়েছিল, তখন আমরা অনেকে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলাম ‘প্রবৃদ্ধি হলেই জনগণের স্বয়ংক্রিয় উন্নতি হবে না’—তখন এসব কথায় কোনো কর্ণপাত করা হয়নি। শাসকশ্রেণি তখন বলতেন, দেশের ধনিকশ্রেণি এই আদিম সঞ্চয়ের পর, দেশেই তা বিনিয়োগ করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন। কিন্তু তারা যে এই বিশ্বায়িত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজির অবাধ গতির সুযোগ নিয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন, সে কথা মোটেও ভাবা হয়নি এবং প্রয়োজনীয় Carrot and Stick তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে একধরনের বৈষম্যমূলক-সুশাসনহীন প্রবৃদ্ধি বা তথাকথিত উন্নয়নের পরিণতি হিসেবে দেখা যাচ্ছে ‘সর্বত্রই ঘাটতি-সর্বত্রই মূল্যস্ফীতি, সর্বত্রই সিস্টেমলস’—শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনার দোহাই দিয়ে এখন আর জনগণকে কোনো বুঝ বা সান্ত্বনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ। অনুলিখন : এম এ খালেক