অভিভাবকরা মেয়ের বাল্যবিবাহের জন্য জন্মনিবন্ধন বারবার পরিবর্তন করে। বাল্যবিবাহের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত বিষয়ক গবেষণা জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। বিয়ের সময় কাজিকে জন্মসনদ দেখানো হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবারে আট বিভাগের ৩৭টি জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের ৭২৩ জন উত্তরদাতার ৩৩৫ জন ‘হ্যাঁ’ এবং ৩৮৮ জন ‘না’ বলেছেন।
বাল্যবিয়ে দেওয়ার জন্য পরিবার কোনো পদ্ধতিতে জন্মসনদ পরিবর্তন করে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ৫৬ জন উত্তরদাতা বলেছেন ‘জানা নেই’। জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জন্মসনদ পরিবর্তন করে বা বয়স বাড়িয়ে বলেছেন ৩০ জন, কম্পিউটারের দোকান থেকে জন্মসনদ পরিবর্তন করে বলেছেন ১৬ জন, নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে জন্মসনদ পরিবর্তন করেছেন পাঁচ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান কনফারেন্স হলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত ‘বাল্যবিয়ের কারণ ও সামাজিক অভিঘাত’বিষয়ক গবেষণা জরিপের তথ্য উপস্থাপনে এসব কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি পরিচালক জনা গোস্বামী।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আব্দুল আজিজ এমপি বলেন, আইন থাকলেও বাস্তব অবস্থার কারণে তা প্রয়োগ করা যায় না। কাজিরা তাদের সুযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাল্যবিয়ে দেন। বংশানুক্রমে কাজির ছেলে কাজি হন। এটা বন্ধ করা গেলে বাল্যবিয়ে বন্ধে সুফল আসবে। এজন্য প্রশাসনের জোরালো ভূমিকা পালনে জনপ্রতিনিধিদের তৎপর হতে হবে। তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে কিশোর-কিশোরী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণের আহ্বান জানান।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাল্যবিয়ের প্রবণতায় জেলাভিত্তিক কোনো পার্থক্য আছে কি না এটা মূল রিপোর্টে আনা যেতে পারে। পালিয়ে বিয়ে করায় বাল্যবিয়ে বাড়ছে—এটাকে জনপ্রতিনিধিদের অজুহাত হিসেবে দেখানো বন্ধ করতে হবে। বাল্যবিয়ে দিলে কন্যা উপবৃত্তি পাবে না, এমন শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করে কিশোরী ক্লাব মনিটরিং করতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধে তথ্যউপাত্তের ঘাটতি দূর করতে সরকারি সংস্থাকে উদ্যোগ নিতে হবে। সভাপতির বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, বাল্যবিবাহ নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। শিক্ষার মান উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাকে পণ্য হওয়া থেকে মুক্ত করে একটি মানবিক শিক্ষা কিশোর-কিশোরীদের দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ দেওয়া পরিবারগুলোর মধ্যে নিম্নবিত্তের হার সবচেয়ে বেশি। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও বাল্যবিবাহের হার প্রায় এক-চতুর্থাংশ, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বাল্যবিবাহ দেওয়া অভিভাবকদের মধ্যে প্রায় ৩১ শতাংশ নিরক্ষর, ৪১ শতাংশ অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন, ২৬ শতাংশ স্বল্প শিক্ষিত এবং শিক্ষিত ৪ শতাংশ।
উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। সমীক্ষার প্রেক্ষাপট আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম ও অ্যাডভোকেট মাসুদা রেহানা বেগম।
এছাড়াও বিশেষ অতিথি ছিলেন এম্বাসি অব সুইডেন, বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার রেহানা খান। সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাতেমা খাতুন।
আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিআইজিডির প্র্যাকটিস অ্যান্ড হেড অব জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন ক্লাস্টারের সিনিয়র ফেলো; কেয়ার বাংলাদেশের উইমেন অ্যান্ড গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের অ্যাক্টিং ডিরেক্টর রওনক জাহান; জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাসিমা আক্তার জলি প্রমুখ।