শুক্রবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

এবারও চামড়ার বাজার মন্দা

সিন্ডিকেটকে দুষছেন ক্রেতারা, ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ করেননি ট্যানির মালিকরা

আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৩, ০৪:৫৫

এবছরও দেশের চামড়ার বাজার মন্দা যাচ্ছে। কোরবানিদাতারা চামড়ার কোনো মূল্য পাননি। সরকার কোরবানির পশুর চামড়া প্রতি বর্গফুট হিসাবে দাম নির্ধারণ করে দিলেও এবছরও মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়নি। বিভিন্ন জেলায় চামড়া ব্যবসায়ীরা পুঁজির অভাবে চামড়া কিনতে পারেনি। চামড়া শিল্পে বিমুখ হয়ে থাকা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের পথে বসিয়ে দিয়েছেন ঢাকার ট্যানারি মালিকরা। করোনা শুরুর আগের বছর থেকে ঢাকার ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনে ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করেননি। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও সব পুঁজি রয়ে গেছে ট্যানারির মালিকদের কাছে। এর বিপরীতে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা থাকায় তারা অনেক বেশি চামড়া সংগ্রহ করতে পেরেছেন। যদিও তারা বলেন, যে দামে তারা সংগ্রহ করেছেন, বিক্রি করতে গিয়ে সে দাম পাচ্ছেন না।  এদিকে, চামড়া বিক্রেতারা দাবি করেন, তারা গরুর চামড়ার আশানুরূপ দাম পাননি। আর ছাগলের চামড়া বিনা মূল্যে দিয়ে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন খরচের কারণে চামড়া সংগ্রহে খরচ পড়েছে বেশি। এছাড়া লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লবণ সংরক্ষণে বেশি খরচ পড়ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।  

বরিশাল অফিস
আর্থিক সংকট, মূল্য কমসহ নানা অজুহাতের মধ্য দিয়ে বরিশালে চলছে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ। তবে সরকার নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও বরিশালে চামড়ার দাম কম হওয়ায় হতাশ চামড়া সংগ্রহকারীরা। এবার কোনো আড়তেই ছাগলের চামড়ার দেখা মেলেনি। পদ্মাবতী এলাকার যে দুই ব্যবসায়ী নগরীতে চামড়া সংগ্রহ করেছেন, তাদের আড়তে শুধু গরুর চামড়া এসেছে। আর মাঠপর্যায়ে চামড়া সংগ্রহকারীরা বলছেন, ব্যবসায়ীরা ফ্রিতেও না নেওয়ায় এবারে গোড়া থেকেই ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করেননি তারা। আর চামড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, খরচ পুষিয়ে না ওঠা এবং ট্যানারির ব্যবসায়ীরাও অনীহার কারণে বিগত বছরগুলোতে ফ্রিতে পাওয়া চামড়াগুলোও ফেলে দিতে হয়।

জামেয়া মাহমুদিয়া মাদ্রাসার মুফতি আতিকুল্লাহ কাসেমী বলেন, হিসেব কষলে পৃথকভাবে একটি ছাগলের চামড়া আনা-নেওয়া, পরিবহন ও সংরক্ষণে ২০০ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু বরিশালে যারা চামড়া কিনেন তারা কোনো দাম দেন না। তাই গরুর চামড়ার সঙ্গে আমরাও সেটি ফ্রিতে রেখে আসি ব্যবসায়ীদের কাছে। আমাদের মাদ্রাসায় গত বছরে ২০০-র মতো ছাগলের চামড়া এসেছিল। সেই চামড়ার কোনো দামই পাইনি এখন পর্যন্ত। পশু কোরবানি কম হলেও বিগত সময়ের থেকে এবারে ছাগলের পরিমাণ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করতে যে কষ্ট ও খরচ হয়, গরুতে তাই হয়, তবে নিজেদের খরচ কমাতে মূল্যহীন ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করিনি। আর শুধু যে, আমরা এমনটা করেছি তাও নয়, বরিশাল নগরীর যে সব এতিমখানা-মাদ্রাসা চামড়া সংগ্রহ করে তাদের বেশির ভাগেই ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করেনি।

স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর
রংপুর নগরীসহ আশপাশের উপজেলায় ব্যবসায়ীরা ১৫-২৫ টাকায় প্রতি বর্গফুট চামড়া ক্রয় করেছেন। এভাবে চামড়া কিনেছেন রংপুরের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে প্রকৃত চামড়া ব্যবসায়ীরা পুঁজি সংকটে চামড়া কিনতে পারেননি। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করেছেন কোরবানির পশুর চামড়া।

চামড়া কেনার কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারেননি পুঁজি সংকটে থাকা ব্যবসায়ীরা। বকেয়া টাকা আদায় ও মূলধনের সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারায় অনেক ব্যবসায়ী এ ঈদে চামড়া কিনতে পারেননি। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী সেখানে গড়েছেন সিন্ডিকেট। তাদের কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিক্রেতা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। 

নজরুল ইসলাম নামে একজন জানান, গরুর চামড়ার দাম ৪০০ টাকা, আর ছাগলের চামড়া দুটি ১৫ টাকায় বিক্রি করতে হলো।

রংপুর সদর উপজেলার পালিচড়া থেকে আসা বুদু মিয়া মৌসুমি ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে কিছু গরুর চামড়া কিনেছি। মোটামুটি চামড়ার মান ভালো, কিনতেও একটু বেশি পড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে এসে লাভ তো দূরের কথা আসল (পুঁজি) টাকাই থাকছে না। একেকটা চামড়া কেনা পড়েছে ৭০০ থেকে ১২০০ টাকা। এখন বিক্রির দাম উঠেছে গড়ে ৭৫০ টাকা করে। ভাবছি বিক্রি না করে বাড়িতে নিয়ে লবণ দিয়ে রাখব।

রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুল লতিফ খান জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা ঈদে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে চামড়া কিনেন। ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা চামড়া ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন। একদিকে পুঁজি সংকট আর অন্যদিকে লবণের দাম বাড়ায় এবারও চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া কিনে কোথায় বিক্রি করা হবে—এ নিয়েই চিন্তিত ব্যবসায়ীরা। এখন চামড়ার দাম নেই।

দেশের প্রায় দুই শতাধিক ট্যানারির মধ্যে এখন মাত্র ১৫ থেকে ২০টি ট্যানারি চালু রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কেউ চামড়া কিনে নতুন করে লোকসানের বোঝা ভারী করতে চাইছে না।

যশোর অফিস
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চামড়ার মোকাম যশোরের রাজারহাটে ঈদ-পরবর্তী শনিবারের প্রথম হাটে বাজারদরে হতাশ হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ক্রয়মূল্য ও লবণ খরচ যোগ করে একটি চামড়ার যে দাম দাঁড়িয়েছে সেই দামে বিক্রি করতে পারছেন না তারা। এদিন ছাগলের চামড়া পানির দরে ৫ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আর গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। লবণ ও শ্রমিক খরচ বাড়তি হওয়ায় অনেকের পুঁজি বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছেন এসব ব্যবসায়ী। তবে আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানভেদে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। ট্যানারি মালিকদের ওপর নির্ভর করছে চামড়ার বাজারের ভবিষ্যত্। আগামী সপ্তাহে বাজার আরো জমজমাট হবে মনে করছেন মোকাম সংশ্লিষ্টরা।

শনিবার সকাল থেকেই যশোরসহ খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা হাটে চামড়া নিয়ে আসেন। স্থানীয় ও বাইরের আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা পছন্দ অনুযায়ী চামড়া ক্রয় করেন। তবে চামড়ার বাজার দরে হতাশ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যশোরের অভয়নগর উপজেলার মহাদেব বিশ্বাস বলেন, গরুর চামড়াপ্রতি খরচ বাদ দিয়ে ১০০ টাকা করে লোকসান হয়েছে। গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা লোকসান হবে আমার। পরের হাটে দাম না পেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

নড়াইলের ব্যবসায়ী হরেন বিশ্বাস ৫০০ পিস গরুর চামড়া আনেন। তিনি প্রতিটি চামড়া ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে কিনেছেন। লবণ, শ্রমিক খরচ ও পরিবহন বাবদ প্রতিটি চামড়ায় আরও ২০০ টাকা করে খরচ হয়েছে। হাটে বড় চামড়া ৮০০ টাকা এবং ছোটগুলো ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে ৫০টি চামড়া বিক্রিই হয়নি। নড়াইলের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী জয়ন্ত কুমার বলেন, সরকার চামড়ার ফুট নির্ধারণ করেছে ৪৮ টাকা। আমরা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে কাঁচা চামড়া কিনেছি। সেই চামড়া লবণ শ্রমিক দিয়ে ৪৫ টাকা খরচ হয়েছে। ঈদের দুই দিন পর চামড়া হাটে নিয়ে এসে দাম পাচ্ছি ১৫-৩০ টাকা। প্রতি চামড়াতেই ১৫ থেকে ২০ টাকা লস হচ্ছে। লস করে তো ব্যবসা করা যায় না। এই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, চামড়াশিল্প আজ ধ্বংসের পথে। চামড়াশিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। চামড়াশিল্পের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। আর আমাদের ন্যায্য দামেই চামড়ার মূল্য দিতে হবে।

বৃহত্তর যশোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দীন মুকুল বলেন, ঈদের দিন দুপুর ও শুক্রবার ১ কোটি টাকার কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে। আর শনিবার ১০ হাজার গরু ও ৩০ হাজার ছাগলের চামড়া এসেছে, সোয়া কোটি টাকায় বেচাকেনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, রাজারহাটে যশোরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলার পাশাপাশি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোরের বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া বেচাকেনা করেন। এই হাটে ঈদের মৌসুমে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার বেশি চামড়া বেচাকেনা হয়।   

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনায় কোরবানির চামড়া নিয়ে বিক্রেতারা সমস্যায় পড়েছেন। চামড়া সিন্ডিকেটের পাল্লায় পড়ে খুব কম দামে চামড়া বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন।  ঈদের দিন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহর এবং গ্রাম থেকে বিভিন্ন যানবাহনে লোকজন কোরবানির চামড়া নিয়ে শহরের বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রে আসতে থাকেন। কিন্তু  চামড়া নিয়ে বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে আসার পর ক্রেতারা প্রথমে চামড়া ক্রয় করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আগে থেকেই চামড়া ক্রয়ের একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়। প্রতি বড় বড় গরুর চামড়ার দাম বলেন, মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। খুব বেশি হলে ৩০০ টাকায় কেনেন ক্রেতারা। যেখানেই যান বিক্রেতা সেখানেই একই ধরনের দাম বলা হয়। ক্রেতারা এখানে সিন্ডিকেট করে চামড়া কিনতে বসেন।

জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে থাকায় এবার কোরবানির চামড়া কেনা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জয়পুরহাটের চামড়া ব্যবসায়ীরা। তাদের আশঙ্কা চামড়া কিনতে না পারলে সেগুলো চোরাকারবারির হাতে চলে যাবে। দেশের কোটি কোটি টাকার চামড়া পাচার হয়ে যাবে ভারতে। এখনই প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের দাবি চামড়া ব্যবসায়ীদের।

ইত্তেফাক/এসটিএম