বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৩০ মাঘ ১৪৩১
The Daily Ittefaq

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সম্মেলন

আপডেট : ১২ জুলাই ২০২৩, ০১:৩০

কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হলো জি-৭ বৈঠক। সেখানে আমরা বিশ্বরাজনীতির একটি নতুন মাত্রা দেখতে পেয়েছি, যেখানে একদিকে পশ্চিমা বিশ্ব, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার যে অবস্থান তা গুরুত্ব পেয়েছে। জি-৭ বৈঠকে আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল। তারই সূত্র ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সামরিক জোট ন্যাটোর সমষ্টিগত নিরাপত্তার যে জোট, তার সমাপ্তি ঘটেনি এখনো।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় অনেক সামরিক জোটেরই বিলুপ্তি ঘটেছ, কিন্তু ন্যাটো তার অবস্থান শক্তভাবে ধরে রেখেছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ন্যাটো স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তীকালে বর্তমান সময়ের মতো একটি কঠিন ও জটিল পরিস্থিতিতে আরেকটি শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করল। এই সম্মেলনে ন্যাটোর সামনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে, যে বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে বর্তমান বিশ্বে যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকগুলো নতুন প্রবণতা তৈরি হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধের মতোই মেরুকরণের সমস্যা ক্রমাগত আমাদের সামনে আরো পরিষ্কার হচ্ছে। সেই মেরুকরণের প্রেক্ষাপটে এই ন্যাটো সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করবে। এই ন্যাটো সম্মেলনে একদিকে যেমন তাদের প্রচলিত নিরাপত্তা বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে আরো ঐক্য সুদৃঢ় করা, তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা ও সামরিক প্রযুক্তি বিনিময় করার মতো বিষয়ও উত্থাপিত হয়েছে।

ট্রান্স আটলান্টিক অঞ্চল, যেটি একসময় বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে নাজুক অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই ট্রান্স আটলান্টিক অঞ্চলকে আরো সুদীর্ঘ করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলো সব সময়ই ন্যাটোর জন্য প্রচলিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে ইউক্রেনে আক্রমণ হওয়ার পর থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ন্যাটো বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পেছনে যে কারণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যেকোনো ধরনের শান্তিচুক্তিতে রাশিয়া এখনো যে বিষয়ে অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে, তা হলো ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হতে না দেওয়া। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ন্যাটোর সম্মেলনে বেশ কিছু বার্নিং ইস্যু আলোচিত হয়েছে এবং সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা বিশ্বরাজনীতির বড় কিছু পরিবর্তন ও নতুন ধারার স্পষ্টতা লক্ষ করব। দৃশ্যত এই ন্যাটো সম্মেলন ইউক্রেন যুদ্ধকেই কেন্দ্র করে ধাবিত হচ্ছে। ন্যাটো ইউক্রেনের পক্ষে ও রাশিয়ার বিপক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ঘোষণা করেছে। সেটি ক্রমাগত তারা করে এসেছে এবং এই সম্মেলনের মাধ্যমে তা আরো বেশি জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আরেকটি দিক হচ্ছে, ন্যাটোকে ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন করতে গিয়ে যে ব্যাপক সামরিক ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, সেটির ব্যাপারে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা এবং এই যুদ্ধের যে খরচ তা বহনে সবার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিষয় এই সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।

ন্যাটোর সামনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সুইডেনের সদস্যপদ। গতকালের খবর অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত তুরস্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চাপে সুইডেনের ন্যাটো সদস্য পদ লাভের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কের যে নির্বাচন হয়েছে, সেই নির্বাচনে বিজয়ী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি বার্গেনিং ক্যাপাসিটি নিয়ে ন্যাটোর সম্মেলনে অংশ নেয়। এতে তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সুবিধা পাওয়ায় সুইডেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনায় আসে, তা হলো ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া নিয়ে। সেটি এই মুহূর্তে দেওয়া যাবে কি না, তা আলোচনায় আসে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, দুই-এক দিন আগে হঠাত্ করেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেছেন ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্য। এটি তুরস্কের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবৃতি। এই বিবৃতি ইউক্রেনকে ব্যাপকভাবে সন্তুষ্ট করবে এবং তাদের পক্ষে যাবে। অন্যদিকে রাশিয়া যদিও এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য করেনি, তবে এ ধরনের বক্তব্যে তাদের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ককে ইইউর সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত করছে পশ্চিমা বিশ্ব। সেই বঞ্চনার জায়গা থেকে তুরস্ক এবার যেটি করল, তা হলো সুইডেনের সদস্যপদ চাওয়া এবং ন্যাটোতে তুরস্কের রেওয়ার্ড ভূমিকা প্রয়োগ করে ইইউর সদস্যপদ ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা। ন্যাটোকে কেন্দ্র করে তুরস্কেরও একটি ভিন্ন কূটনৈতিক কৌশল ও স্বার্থের জায়গা রয়েছে।

 অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, এই ন্যাটো সম্মেলনকে চীন ও রাশিয়া তাদের বিরোধী জোট হিসেবে চিহ্নিত করছে। এবারের ন্যাটো সম্মেলনে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের একটি বিষয় আমরা দেখতে পাচ্ছি। নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য পশ্চিমা বিশ্বের ন্যাটোকে ব্যবহার করার প্রবণতা লক্ষণীয়। যে ঘটনা অতীতে কখনোই আমরা দেখিনি, এমনকি স্নায়ুযুদ্ধের সময় বা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তীকালেও লক্ষ করা যায়নি। এখন ইউক্রেন যুদ্ধের সময় দেখতে পাচ্ছি, ন্যাটোর একটি ভিন্ন ধরনের এক্সপানশন হচ্ছে। বিশ্বরাজনীতির জন্য এটি নতুন একটি টার্নিং পয়েন্ট। এটি বিশ্বের নয়া মেরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে। একই সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধের তিক্ত পরিবেশের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ন্যাটো প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ন্যাটো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, কিন্তু বর্তমানে যে কঠিন সময় পার হচ্ছে, তাতে ১৯৯১ সালের পর থেকে এতটা কঠিন ও জটিল প্রেক্ষিতে ন্যাটোর সম্মেলনে আর কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। 

ইউক্রেন যুদ্ধ ৫০০ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। যে যুদ্ধটি ক্ষণস্থায়ী হতে পারত এবং যেটি কারো কাছে কাম্য নয়, কিন্তু ক্রমাগত ধারাবাহিকভাবে চলছে। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বড় ক্ষতি হচ্ছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে এর প্রভাব পড়ছে। কিন্তু এই যুদ্ধে কীভাবে ইউক্রেনকে জয় করা যায় অথবা পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে, সেটি ন্যাটোর অন্যতম কৌশলগত লক্ষ্য। একদিকে ন্যাটোর সদস্য হিসেবে ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি, অন্যদিকে ইউক্রেনকে নিয়ে তাদের একটি বিশেষ ঘোষণা থাকারই কথা। যদিও জার্মানি ইতিমধ্যে বলেছে, যত দিন রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দ্বন্দ্ব থাকবে, তত দিন ন্যাটোর সদস্য হওয়া সম্ভব হবে না। এ বিষয়গুলো আমরা সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই যে, বিশ্বরাজনীতি ও বিশ্বনিরাপত্তায় ন্যাটোর অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও শক্তিশালী হচ্ছে। ন্যাটোকে এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শিত হচ্ছে, কিন্তু এর একটি বড় প্রভাব হচ্ছে এ ধরনের সামরিক জোট তাদের এক্সপানশন কিংবা তাদের তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে বিশ্বের অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফ্যাক্টরকে আরো বেশি উন্মোচিত করে দিচ্ছে। একই সঙ্গে মেরুকরণের সুযোগ বাড়াচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই মুহূর্তে বিশ্বের আরো কিছু শক্তি, যেগুলো সামরিক জোট না হলেও আঞ্চলিক পর্যায়ের সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করছে এবং সেগুলোর মাধ্যমেও একধরনের কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক তৎপরতা শুরু হয়েছে।

একদিকে ন্যাটো যেমন পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একটি বড় ধরনের সামরিক প্ল্যাটফরম, অন্যদিকে সামরিক দিক থেকে না হলেও কূটনৈতিক দিক থেকে এ ধরনের প্ল্যাটফরম বড় ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি ব্রিকসের বিষয়টিও আমাদের সামনে আসছে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন হয়েছে এবং ব্রিকসের সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সেখানে বাংলাদেশের সদস্যপদ পাওয়ারও একটি সম্ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছে। দৃশ্যত, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এসব সংস্থার মতের পার্থক্য রয়েছে। কিংবা যে ধরনের স্যাংশন বিশ্বে বিরাজ করছে বা অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছে বা আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে মতপার্থক্য বিরাজ করছে, সেগুলো এ ধরনের জোটের পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিকা রাখছে। তাদের স্বার্থের সমীকরণে পরিবর্তন আসছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাচ্ছি। যে ধরনের নিরাপত্তা ও সামরিক পরিবেশ এখন কাজ করছে, গত এক দশক আগেও তা লক্ষ করা যায়নি। এক দশক আগেও যে দেশগুলো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নানা সমস্যার সমাধান করেছে, সেই দেশগুলো এখন পরস্পরের কাছে বৈরী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই সম্মেলন পশ্চিমা বিশ্বকে আরো সুসংহত করবে, কিন্তু অন্যান্য যে দেশ আছে বা গুরুত্বপূর্ণ যে শক্তিগুলো আছে, তাদের নিজেদের নিরাপত্তায় একধরনের শঙ্কা তৈরি হবে। ন্যাটো সম্মেলনের প্রতিপদ্য বা আউটকাম শুধু ইউরোপ বা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য  নয়, এটির প্রভাব সমগ্র বিশ্বে থাকবে। প্রত্যাশা রাখি, ন্যাটোর সিদ্ধান্ত সামগ্রিক বিশ্বের মানুষের পক্ষে থাকবে, সবার উন্নয়নের কথা বলবে।

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য, পিএসসি

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন