শনিবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

জমি নিয়ে বিরোধে এখলাস খুন, ২০ লাখ টাকায় খুনি ভাড়া

আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২৩, ২২:১০

রাজধানীর হাজারীবাগের জমি ব্যবসায়ী এখলাস কামরাঙ্গীরচরে ৪০ শতক জমি কিনেছিলেন। ঐ জমিতে এশিয়ান লেদার ও আইয়ুব ব্রাদার্স ট্যানারির মালিক মনিরেরও অংশীদারিত্ব ছিল। এক সময় এই জমির মালিক ছিলেন লালবাগের বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু। তার স্ত্রী কল্পনা আক্তারের কাছ থেকে এখলাস ও মনির জমি কিনেন। আর সেই জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণ করা জমির ক্ষতিপূরণসহ মূল্য প্রায় ৯০ কোটি টাকা। ওই অর্থ মনির নিজে একাই নিতে চেয়েছিলেন, অন্যদিকে এখলাস তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এখলাস ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে ক্ষতিপূরণের অর্থ তাকে দেওয়ার আবেদন করেন। দুই পক্ষের এই দ্বন্দ্বে জেলা প্রশাসক অর্থের ছাড় স্থগিত করে দেয়। অর্থ পাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে ২০ লাখ টাকার চুক্তিতে ভাড়াটে খুনি দিয়ে ব্যবসায়ী এলখাসকে হত্যা করা হয়।

পুলিশ বলছে, জমি নিয়ে বিরোধ ছাড়াও এখলাসকে হত্যার ঘটনায় আরেকটি কারণ ছিল। আর তা হলো এখলাসের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে মনিরের সম্পর্ক। এ দুই কারণেই ট্যানারি ব্যবসায়ী মনিরের পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় এখলাসকে। গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া শাখায় এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন ডিবির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। ডিবির ভাষ্য, প্রান্তিক ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির মালিক ট্যানারি ব্যবসায়ী মনির এ হত্যায় জড়িত।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ব্যবসায়ী এখলাস খুনে প্রথমে গ্রেফতার হন মরদেহ গুমে জড়িত এক জন ভ্যানচালক ও স্থানীয় একটি টেইলার্সের এক জন মালিক। পরে দুই জন ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে এখলাস খুনের পরিকল্পনাকারী মনিরকে যশোর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পাশাপাশি খুনে জড়িত ঝন্টু মোল্লা, খুনের সমন্বয়কারী এসহাক, খুনে জড়িত ‘কিলার’ আবদুর রহমান ও ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় মনিরের কাছ থেকে দুটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট, একটি মোবাইল, ২২ হাজার বাংলাদেশি টাকা আর ৫ হাজার ইন্ডিয়ান রুপি উদ্ধার করা হয়।

ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ জানান, ‘ভূমি ব্যবসায়ী এখলাসের সঙ্গে মনিরের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এখলাসকে দিয়ে বিভিন্ন সময় জমি দখল ও বেচাকেনা করিয়েছেন মনির। কামরাঙ্গীরচরে একটি দাগে তাদের পাশাপাশি জমি রয়েছে। সেখানে এখলাসের জমি আছে ৪০ শতাংশ। ঐ জমি সরকার অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং অধিগ্রহণ মূল্য বাবদ ৯০ কোটি টাকা পাশ হয়েছে। এখান থেকে মনিরের প্রাপ্য ৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু এখলাস পুরো টাকাটা তাকে দেওয়ার আবেদন করে। আবার মনিরও পুরো টাকাটা একাই গ্রাস করতে চেষ্টা-তদ্বির করতে থাকেন। একপর্যায়ে জেলা প্রশাসক পুরো টাকাটাই আটকে দেন। এতে মনির ভাবতে থাকেন ৯০ কোটি দূরের কথা তার ভাগের ৩৫ কোটি টাকাই পাচ্ছেন না।’

তিনি বলেন, এখলাসের দ্বিতীয় স্ত্রী বিথীকে ঘিরেও তাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বিথীর সঙ্গে এখলাসের বিয়েটা মনিরই দিয়েছিলেন। বিয়ের পরে এখলাস জানতে পারেন, মনিরের সঙ্গে বিথীর একটা সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। বিয়ের পরও বিথীর সঙ্গে মনিরের সম্পর্ক রয়েছে বলে জানতে পারেন তিনি। এ নিয়ে মনিরের সঙ্গে এখলাসের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এসব  কারণে ভাড়াটে খুনি দিয়ে এখলাসকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মনির।

ডিবি জানায়, এখলাসকে হত্যা সহযোগী ঝন্টু মোল্লার সঙ্গে ২০ লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন লেদার মনির। অন্যদিকে ঝন্টু ঐ টাকা চুক্তির পর দুই জন ভাড়াটে খুনি ঠিক করেন যারা এখলাসকে হত্যা করবে। এখলাসকে খুনের জন্য উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল ঈদুল আজহার আগের রাত। সেই রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন এখলাস। নিখোঁজের দুই দিনের মাথায় কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধ থেকে তার বস্তাবন্দী মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এখলাস খুনের পর এ ঘটনায় ১ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানায় একটি মামলা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, মনির নোয়াখালীর দিনমজুর আবদুর রহিমের ছেলে। তার বাবা হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানায় একসময় কাজ করতেন। সেখানে মনিরও শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। ২০০১ সালের পর মনির ট্যানারি এলাকায় তার ক্যাডার বাহিনীর জন্য পরিচিতি পায়। পরে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজে চামড়ার কেনাবেচা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি ভূমিও দখল করেন।

মনিরের আরও দুষ্কর্ম

মনির ২০০২ সালে সিকদার পেট্রোল পাম্পের সামনে রুহুল আমিন নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে গুলি করেন। ঐ ঘটনায় মনির গ্রেফতার হন। পরে নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মধ্যস্থতায় রুহুল আমিনের স্ত্রীর সঙ্গে মনির আপসনামা করেন। ১ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে রুহুল আমিনের স্ত্রী মামলার অভিযোগ থেকে মনিরের নাম প্রত্যাহার করে নেন। ২০১৫ সালে জসিম ওরফে গুণ্ডা জসিম নামের একজনকে হাজারীবাগ বাজারে ইফতারের আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে গুলি করে হত্যা করান তিনি। মনির তার ডেভেলপার কোম্পানির ব্যবসার জন্য কারাবন্দি ইমনের ক্যাডার বাহিনীকে ভাড়ায় ব্যবহার করতেন। এখন তিনি দুটি ট্যানারি ও একটি ডেভেলপার কোম্পানির মালিক। এছাড়া মনির আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

ইত্তেফাক/এমএএম