মটরবাইকে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম ছুটলাম। যেতে যেতে মাঝেমধ্যে নানা জায়গায় ব্রেক কষে আলাপ জমিয়েছিলাম স্থানীয়দের সঙ্গে। এটি আমার ভ্রমণের একটি নিয়মিত অংশ। বিভিন্ন জায়গার মানুষের সুখ-দুঃখের ধারণা পেতে পেতে সময় গড়িয়ে রাত ৮টায় পৌঁছি কিশোরগঞ্জ। শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের পাশে থাকা পূর্বপরিচিত এক মাদ্রাসার মেহেমানখানায় উঠি। রাতটা কাটিয়ে সকাল সকাল বালিখোলা ঘাট দিয়ে ফেরিতে পার হই। ধনু নদীর সৌন্দর্যও কম যায় না।
ফেরি হতে নেমে কিছুটা পথ আগাতেই যেন মনে হলো— আমি কোনো সড়কে নেই, বরং রয়েছি কোনো বিমানবন্দরের রানওয়েতে। হাওরের বুকে মসৃণ পিচঢালা পথ। যেটাকে বাইকাররা চলতি কথায় ‘মাখন মারা রোড’ বলে থাকি। মূলত এটাকে কেতাবি ভাষায় ‘মারসেবল রোড’ বলা হয়ে থাকে। পথের নজরকাড়া সৌন্দর্যে বাইকের গতি বাড়তে বাড়তে নয়াগাঁও গ্রামে গিয়ে ব্রেক। সেখানকার জমিগুলোতে কৃষক-মজুরদের ধান কাটা চলছিল। যাকে বলে কৃষকদের নতুন ধান গোলায় তোলার উত্সব। আহারে জীবন। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ। তবুও চোখেমুখে হাসি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সবচাইতে বেশি পরিশ্রমী ও ত্যাগী মনে হয়—যারা রয়েছেন কৃষি কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মাঠে কাজ করা কৃষকদেরকে সামনাসামনি না দেখলে বোঝা যাবে না তাদের জীবনযাপন কতটা কষ্টকর। জমি নিড়ানি, বীজ বপণ থেকে শুরু করে একেবারে ফসল বাজারজাত করা পর্যন্ত অক্লান্ত দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রম করেই যেতে হয়।
ভ্রমণে মানুষের যাপিত জীবন ও এসব অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জনই ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র মূল লক্ষ্য। কৃষকদের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে ছুটে চলি জেলার ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের সুবিস্তৃত হাওরের বুকে কাজ করা ধান চাষিদের সান্নিধ্যে। প্রথমেই মিঠামইন উপজেলার নয়াগাঁও এলাকার যে জমিতে নামি, সেখানে দেখি প্রখর রোদে পাকা ধান কেটে তা মাথায় তুলে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে রাখছে। কৃষকদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলমান বাজার পরিস্থিতিতে তারা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, তা প্রত্যেকের মুখ থেকে আলাদা আলাদা ভাবে শুনি। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে কৃষকদের নানা সুখ-দুঃখের গল্প জমে উঠে। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অথচ এদেশে কৃষকরা আজও অবহেলিত। এখানকার কৃষকদের উত্পাদিত ধান ছিল রাতা ও হিরা। স্থানীয়ভাবে রাতা ধান হতে ছাঁটাই করা চালকে জামাইমুখিও বলে থাকে। এটা মূলত পোলাওর চাল। হিরা হলো মোটা ভাতের চাল।
এরপর ছুটে যাই ইটনার পথে। যেতে যেতে আসনপুর গ্রামে গিয়ে থামি। কথা হয় কৃষকদের সঙ্গে। তারা ২৯ ও ৫৮ জাতের ধান তুলেছে। তাদের ফসল বেশ ভালো হয়েছে। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করা গেল— এবার কিছুটা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারেন তারা। আশার কথা শুনতে পেরে আমাদের মনটাও কিছুটা ভালো হলো। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারো ছুটছি। এবার দেখব ইটনা উপজেলার প্রাচীনতম শাহী মসজিদ। যেটাকে স্থানীয়রা গায়েবী মসজিদ হিসেবে চিনে। যেতে যেতে উপজেলা সদর বড়হাটি গ্রামের গায়েবী মসজিদের সামনে পৌঁছি। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট কারুকার্যখচিত মসজিদটি প্রথম দর্শনেই মনের ভিতর অন্যরকম ভালো লাগার দোল খেলে গেল। মোঘল স্থাপত্য শৈলী অনুকরণে মসজিদটির নকশা তৈরি করা।
জানা যায়, প্রায় ৪২৫ বছরের পুরনো ইটনা শাহী মসজিদ। বার বার অপরিকল্পিত সংস্কারের কারণে এর নির্মাণকাল লেখার শিলালিপি পলেস্তারের নীচে ঢেকে যাওয়ায় সঠিক সন-তারিখ জানা যায়নি। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা বারো ভূঁইয়াদের প্রধান ঈশা খাঁ’র সভাসদ মজলিশ দেলোয়ার। মসজিদ সম্পর্কে কথা হয় স্থানীয় এক মাদ্রাসার পরিচালক হাফেজ নূরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, মসজিদটির নামকরণ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। এ অঞ্চলের বাসিন্দারা ইটনা শাহী মসজিদটিকে গায়েবী মসজিদ হিসেবেই মনে করে। বর্তমানে মোতোয়াল্লির দায়িত্বে আছেন দেওয়ান শাকিল সাহেব। মসজিদের ভিতরটাও দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যময়। আরো একটা লক্ষণীয় বিষয় হলো, মসজিদের ভেতরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ছাড়াই অবিশ্বাস্য রকমের ঠান্ডা। অথচ সেদিন দেশে তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। মসজিদের সামনের অংশে উঠোন আকৃতির বড় বারান্দা রয়েছে। মসজিদের দৈর্ঘ্য ২৪ মিটার ও প্রস্থে প্রায় ১০ মিটার। তিনটি দরজা ও মেহরাব সহ শাহী মসজিদটির দেয়ালের পুরুত্ব ২ মিটার। মসজিদটি কয়েক শ’ বছর ধরে মোঘল স্থাপনা শৈলীর অনন্য সৌন্দর্য বহন করে চলেছে। যেখানে আজও পাঁচ ওয়াক্ত আজানের ধ্বনি ছড়ানো হয়। আদায় হয় জামাতের সঙ্গে নামাজ। সবকিছু মিলিয়ে ভাটি অঞ্চলের অনুপম প্রাচীন নিদর্শন শাহী তথা গায়েবী মসজিদটি দেখে পর্যটকরা বেশ পুলকিতই হবেন।
এবার ছুটছি অষ্টগ্রামের পথে। পথের মায়ায় আমাদের পথেই মন বেঁধে যায়। তাই চলার পথে ক্ষিপ্র গতির বাইকের ব্রেক বার বার কষতে হয়। বর্ষায় হাওরে থাকে টইটুম্বুর পানি। সাগরের মতো থাকে উত্তাল। আকাশে মেঘ জমলেই হয় অশান্ত। আবার একসময় এসব আছড়েপড়া উত্তাল ঢেউ তোলা হাওরগুলোই হয় বিস্তৃর্ণ ফসলের জমি। এ হলো হাওরের বিভিন্ন মৌসুমে নানা রূপ।
বাইক চলতে চলতে পৌঁছলাম অষ্টগ্রাম সীমানায়। এরইমধ্যে সূর্য হেলে পড়েছে। রাতে হাওরের পরিবেশ থাকে ভিন্ন। যোগ-বিয়োগ করে নিরাপত্তার স্বার্থে অষ্টগ্রামের ঐতিহাসিক কুতুব শাহ মসজিদের দিকে অগ্রসর না হয়ে, বাজিতপুর হয়ে ঢাকা ফেরার পথ ধরি।
যাবেন যেভাবে
সায়েদাবাদ অথবা মহাখালী হতে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস চলাচল করে কিশোরগঞ্জ রুটে। বালিখোলা ও চামড়া বন্দর ঘাট দিয়ে মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রাম যাওয়া যায়। এসব রুটে নিয়মিত লেগুনা, সিএনজি চলাচল করে। সবচেয়ে ভালো, যদি নিজস্ব মটরবাইকে যাওয়া যায়।
থাকা-খাওয়া
রাতে থাকতে চাইলে কিশোরগঞ্জ শহরে ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া শহর জুড়ে খাবারের হোটেল রয়েছে।
সতর্কতা
মটরবাইকের গতি যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়।