ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাস বর্ষাকাল। দুই বছর আগে ২০২১ সালে বর্ষাকালে রাজশাহীতে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, গতবছর ও চলতি (২০২২-২০২৩) বছর মিলিয়ে সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত এখনো রাজশাহীতে হয়নি। ফলে শ্রাবণেও প্রকৃতি হয়ে উঠেছে রুক্ষ। খাল-বিল, নদী-নালা সবকিছুই পানিশূন্যতায় ভূগছে। ফসলের মাঠে বিরাজ করছে পানির জন্য হাহাকার। এই ভরা বর্ষাতেও রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে প্রতিদিন পানি সেচ দিতে হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে। সেচের পানি না দিলেই ধানের জমি ফেটে চৌচির হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ৫০-৬০ ভাগ বৃষ্টিপাত কমেছে। এবার বৃষ্টিপাত আরো কমে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভরা বর্ষাতেও চৈত্র মাসের মত খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে রোপা আমনের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষকরা। বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের চারা রোপণ করা যাচ্ছে না। আবার যেসব জমিতে ইতিমধ্যে আমনের ধানের চারা রোপণ করা হয়েছিল, সেসব জমির ধানগাছ পানির অভাবে মরে যাচ্ছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র মতে, চলতি বছর রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার, জুনে ৮৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার, মে মাসে ১০৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার, এপ্রিলে ৪৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার ও মার্চে ২১ দশমিক ৫ মিলিমিটার। সূত্র মতে, গত বছর জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩৬৬ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৫৯ এবং জুনে ৭০ দশমিক ২ মিলিমিটার। তবে ২০২১ সালে জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে ৮৫২ দশমিক ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৩৩৮ দশমিক ১ মিলিমিটার, জুনে ২৬২ দশমিক ৩ মিলিমিটার, মে মাসে ২৩৭ দশমিক ২ মিলিমিটার ও এপ্রিলে ১৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। ঐ বছর গোটা বর্ষায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয় রাজশাহীতে। কিন্তু গত দুই বছর মিলেও সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি। গতবছর আর চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬২ দশমিক ৭ মিলিমিটার। যা ২০২১ সালের তিন মাসে হয়েছিল ৮৩৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পানির অভাবে জমিতে পাট কাটতে পারছি না। পাট কাটার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জাগ দেওয়ার পানি না থাকায় পাট কাটতে পারছি না। এতে পাটের ফলনও ভালো হবে না, আবার পাট কাটতে না পারায় ঐ জমিতে আমন ধানও লাগাতে পারব না। ইতিমধ্যে যারা ধানের চারা রোপণ করেছেন, তাদের জমির ধানও খরায় নষ্ট হচ্ছে। ধান বাঁচাতে জমিতে ডিপটিউবওয়েল দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে। কিন্তু ঠিকমতো বিদ্যুত্ না থাকায় ডিপ চালানো যাচ্ছে না। ভরা বর্ষায় এমন পানির সংকট কখনো আগে দেখিনি।’ পবা উপজেলার চৈতন্যপুর এলাকার কৃষক আমজাদ আলী বলেন, ‘মাসখানেক আগে জমিতে আমনের চারা রোপণ করেছি। এখন পানির অভাবে প্রতি দিন সেচ দিতে হচ্ছে। সময় মতো সেচ না দিলে জমি ফেটে যাচ্ছে।’
রাজশাহীর ইতিহাস গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘টানা চার-পাঁচ দিন বৃষ্টিপাত তো আর দেখি না। ১৫-২০ বছর আগেও আমরা বর্ষায় টানা কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত দেখেছি। সারাদিন শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরেছে। ঘর থেকে বের হওয়া যায়নি। এখন শ্রাবণেও খরায় পুড়ছে রাজশাহী অঞ্চল।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, বৈশিক উষ্ণায়নের ফলে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। গত দুই বছরে রাজশাহীতে অন্তত ৫০-৬০ ভাগ বৃষ্টিপাত কমেছে।
এদিকে রাজশাহী কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, ‘ইতিমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এখনো সময় আছে। বাকি জমিতে আমন চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’