শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মোহাম্মদ রফিক: ‘কী ফুল বিপুল তমিস্রায়’

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৫:২৭

‘এই শুরু, এই শেষ, এই শেষ যজ্ঞ, অশ্বমেধ;
শেষ পঙিক্ত; বিসর্জন। দশমীলর দুঃখিনী আন্দার
তুমুল পদ্মার বুক হাঁক ছাড়ে, গীত ক’ কুবের
অন্য জলে জাল ফেলে শীতে কাঁপে, রাত্তির মহীম’

এটা মোহাম্মদ রফিকের কপিলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পঙিক্ত। কপিলায় মোহাম্মদ রফিক বাংলাদেশের আবহমান কালের আনন্দ-বেদনা মানুষের চরিত্র ও নন্দন একেবারে অনুপুঙ্খ আঁকতে পেরেছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী সুলতানের মতোই।

‘সোনার খাটে মাথা রুপোর খাটে পা/কী—আশ্চর্য/স্বেচ্ছায় ডাইনিবুড়ির/সোনার পালঙ্কে উঠে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লে।/ ...মাথার কাছে সোনার কাঠি, পায়ের কাছে রুপোর;/দিনরাত্তির অন্ধকার ঘিয়ের পিদিম জ্বলে।/কড়িকাঠে সুতাশঙ্খ সাপ,পাহারায়/ স্বপ্নে; রাজকুমার, পঙ্খীরাজ, হাতে নাঙ্গা তলোয়ার; রাজপ্রাসাদের সিঁড়ি নেমে গেছে অনেক দূর,/ধাপে ধাপে কালো রক্তের ঝলসে/ওঠা দাগ/দীর্ঘ শতাব্দীর/সবকিছু এতো ঠুনকো হ’য়ে এলো...’

...মৃত্যুর ভেতর দিয়ে কি সবই ঠুনকো হয়ে যায় আদতে? সারা জীবনের ধ্রুপদসাধনা কখনো ঠুনকো হয় না। মোহাম্মদ রফিকের সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল প্রচারিত কবিতা ‘খোলা কবিতা’র বছরেই প্রকাশিত হয়েছিল কপিলা। কপিলা অনেক মিথ, রূপকথা, লোককথার টুকরো টুকরো যুগপত্ সম ও অসমধর্মী উপাখ্যানকে আশ্রয় করে দক্ষিণবাংলার দৈন্য-হতাশা-ক্ষুধা-দারিদ্র্যসমেত রাষ্ট্রকে নিয়ে এক বিশাল ক্যানভাসের আখ্যান—সব মিলে এক মহাকাব্যিক ভাববিস্তার।

কপিলায় মোহাম্মদ রফিক নানা ছন্দে নানা মাত্রাবিন্যাসে কখনো গদ্যে কখনো অক্ষরবৃত্তে কখনো গীতিময়তায় কখনো নিখাঁদ কঠিন গদ্যের অবতারণা করেছেন। এত এত ভাঁজ, কিন্তু কখনোই মনে হয় না একটা আরেকটা থেকে আলাদা। একটি বাস্তবতার রাজনৈতিক অভিমান ও ক্ষোভকে কবি অতীত ও বর্তমানের মিশেলে পরিবেশন করেছেন। সেখানে তিনি আশ্রয় যেমন নিয়েছেন ময়মনসিংহ গীতিকায়, তেমনি একেবারে নিরেট গদ্যে তুলে ধরেছেন চিরায়ত চাহিদার গল্প। বয়ানের কৌশল ও সৌন্দর্যে কাব্যিকশক্তিতে কপিলা ক্ষুধার ক্ষুরধার বিশ্বকে অন্য সব ঐহিক অলীক গল্পের সূত্র ধরে পাঠকের শিরা-ধমনিতে গলিয়ে গলিয়ে ঢুকিয়ে দেয়।

কপিলা ও খোলাকবিতা ছাড়াও মোহাম্মদ রফিকের ‘কীর্তিনাশা’ (১৯৭৯), ‘গাওদিয়া’ (১৯৮৬), ‘স্বদেশী নিঃশ্বাস তুমিময়’ (১৯৮৮), ‘মেঘে এবং কাদায়’ (১৯৯১), ‘রূপকথা কিংবদন্তি’ (১৯৯৮), ‘মত্স্যগন্ধা’ (১৯৯৯), ‘কালাপানি’ (২০০৬), ‘নোনাঝাউ’ (২০০৮), ‘দোমাটির মুখ’ (২০০৯), ‘অশ্রুময়ীর শব’ (২০১১), ‘কালের মান্দাস’ (২০১২), ‘ঘোরলাগা অপরাহ’ (২০১৩), ‘বন্ধু তুমি প্রসন্ন অবেলায়’ (২০১৫) এবং দুটি নতুন আখ্যানকাব্য ‘এ কোন বেহুলা’ ও ‘সে ছিল বেদেনি’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

বাংলা কবিতার ধারায় মোহাম্মদ রফিক এক আউটকাস্ট। তার পূর্বসূরি এখানে দুজন, এক. রবীন্দ্রনাথ আরেকজন তিরিশের বড় কবি    বিষ্ণু দে। মোহাম্মদ রফিক তাঁর প্রিয় কবিদের কথা জিগ্যেস করলেই বলতেন সেসার ভায়েহোর কথা। কী আছে মোহাম্মদ রফিকের কবিতায়—কপিলা পড়লে নতুন পাঠক একটু ধারণা পাবেন। তাঁর কবিতা যে কোনো পাঠককে দেবে এ অঞ্চলের নান্দনিক কাব্যিক প্রকরণের স্বাদ। তাঁর চাছাছোলা নিরাসক্ত বর্শায় তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘এইভাবে ভিজে-ভিজে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে? এই দেশে বন্যার কি শেষ আছে? মারী ও মড়কের?’

মোহাম্মদ রফিক সেই বিরলপ্রজ কবিদের একজন, যাঁরা কি না কবিতার নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় নিজের যাপিত জীবনের চারিধারের একেবারে জীবন্ত, চেতনাময়, সংক্ষুব্ধ উপাদানরাশির উপস্থিতি ঘটান। হেগেলে দ্বৈতাদ্বৈতবাদের যে চিরায়ত বৈপরীত্য—তাকে আশ্রয় করে বলা যায় গড়ে ওঠে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার শরীর। ‘শীত, শীত/দু হাঁটুতে সিঁধিয়েছে মৃত্যুভীতি/মনে লয়/আসন্ন বিলয়/সর্বমানুষের/দ্যাখ, ন্যাড়া কঞ্চিতে ধরেছে ফুল/পূর্ণিমার’ (কবিতা—শীত)।

কবির কাজ তো স্বপ্ন দেখানো, প্রবল শীতেও কবি মোহাম্মদ রফিক ন্যাড়া কঞ্চিতে পূর্ণিমার ফুলের আশাবাদ লিখেছেন। জন্ম-মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুক যে কতভাবে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়—‘আসার সময়, আসে একইভাবে, একই পথ ধরে,/সাক্ষী তার মাতার জরায়ু, বনমালতীর ঊরু;/যাবার বেলায়, যার যার যার মতো, ভিন ভিন,/বলে ওই স্ত্রীগহ্বর, মাঠে-মাঠে মাঘের ফলন/বয় হাওয়া, আমৃত্যু খাতের দুই পাশে ধাবমান/উড়ো খড়, বালুস্রোত, কী ফুল বিপুল তমিস্রায়’ (কবিতা—দোমাটির মুখ)। তমিস্রা শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়—অর্থাত্ ঘোর অন্ধকারময়। 

এই যে ধ্রুপদের দিকে মোহাম্মদ রফিকের চিরযাত্রা, তা তো দেখে আসছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে, এক ধ্যানী নিগূঢ় শিল্পসাধনজীবন কাটিয়েছেন কবি মোহাম্মদ রফিক সারা জীবন। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর পড়তে যাই তখন এক রূপকথার কিংবদন্তি চলছে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে, ক্যাম্পাস যেমন কবিদেরই ক্যাম্পাস, যেখানে রাজাসনে মোহাম্মদ রফিক, বিরোধীদলের প্রধান সেলিম আল দীন। দু দিন পরপর বাংলা সাহিত্যের কবিদের নিয়ে ক্যাম্পাসে চলে আসেন, সেলিম স্যারের আহ্বানে এই কবিতা পাঠের আসর হচ্ছে তো অন্যদিকে মোহাম্মদ রফিকের কথায় আলাপে জমে উঠছে প্রান্তিকে কবিতার আড্ডা। আহা কত কত মুখ মোহাম্মদ রফিক-সেলিম আল দীন বৃত্ত ঘিরে...এইসব মানুষকে কাঁদিয়ে বৈটপুরে নিজের মায়ের সমাধির পাশে কবর হয়ে গেল মোহাম্মদ রফিকের। অথচ দেখুন কত আগে তিনি জলনৌকো কবিতায় লিখেছেন—‘আমাকে কবর দিও জলে;/আমাকে কবর দিও জলের ভিরমিতে;/সে তখন প্লাবনের তীর-ঘেঁষে পড়ে থাকা নাও। (জলনৌকো, নোনাঝাউ, ২০০৮), যেন জানতেন এমন শ্রাবণে মেঘে এবং কাদায় তিনি চলে যাবেন।

কবিতার বাইরে লিখেছেন বাংলাভাষার কবিতার্থীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য তিনটি গদ্যগ্রন্থ—আত্মরক্ষার প্রতিবেদন, ভালোবাসার জীবনানন্দ আর দূরের দেশ নয় আয়ওয়া। বৈশাখী পূর্ণিমা দিয়ে ১৯৭০-এ যে কবিতাযাত্রা শুরু হলো, আর তা শেষ হলো শ্রাবণী পূর্ণিমার পাঁচ দিন পর, গত রবিবার।

কবির মৃত্যু নেই, মোহাম্মদ রফিক নশ্বর দেহ ছেড়ে এবার অমর হলেন।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন