শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মহাদেব সাহার কবিতা: সৌন্দর্যচেতনা ও সম্প্রীতির প্রেরণা

আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১৫:৩২

মহাদেব সাহা বাংলা কবিতায় বোধদীপ্ত চেতনার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। মানবতা যার মূল প্রেরণা। কবিতার শব্দ নির্বাচনে মহাদেব সাহা ভীষণ সচেতন, শব্দপ্রয়োগে পুনর্বিবেচনা করেন কবি। ভাবেন বাক্যে শব্দটি কতটা উপযোগী, এর চাইতে গ্রহণযোগ্য শব্দ আর হতে পারে কি না, ইত্যাদি। ফলে তাঁর কাব্যভাষা লাভ করেছে স্বতন্ত্ররূপ। লাবণ্য এবং সৌন্দর্যকে ধারণ করে আছে তাঁর কবিতা। মহাদেব সাহা এত প্রেমের কবিতা লিখেছেন, তবু যৌনাক্রান্ত শব্দের ব্যবহার নেই তাঁর কবিতার পঙিক্ততে। কবিতায় তিনি যখন সঙ্গম শব্দটি ব্যবহার করেন, এর সঙ্গেই জুড়ে দেন সত্কার, প্রেম ইত্যাদি শব্দ। এখানেই তাঁর বোধ-বোধি, চিন্তা-দর্শন ও মন-মননের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

শীলন ও সাধনায় মহাদেব সাহা আধুনিক বাংলা কবিতায় স্বীয় অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। বইয়ের নামকরণ খেয়াল করলেই বোঝা যায় কবির চিন্তা-দর্শন—কেন তিনি আলাদা। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ সময়েরই প্রতিরূপ। এরপর একে একে ‘মানব এসেছি কাছে’, ‘চাই বিষ অমরতা’, কী সুন্দর অন্ধ’, ‘ধুলোমাটির মানুষ’, ‘ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘লাজুক লিরিক’, ‘আমূল বদলে দাও আমার জীবন’, ‘অন্তহীন নৃত্যের মহরা’, ‘একবার নিজের কাছে যাই’, ‘পাতার ঘোমটা-পরা বাড়ি’, ‘স্বপ্নে আঁকি সুন্দরের মুখ’, ‘বহুদিন ভালোবাসাহীন’, ‘সব দুঃখ ভুলে যাই প্রেমের গৌরবে’, ‘সোনালি ডানার মেঘ’, ‘শুকনো পাতার স্বপ্নগাথা’, ‘দুঃসময়ের সঙ্গে হেঁটে যাই’, ‘সন্ধ্যার লিরিক’, ‘অন্ধের আঙুলে এত জাদু’, ‘অক্ষরে বোনা স্বপ্ন’, ‘মাটির মলাট’—এ-ই মহাদেব সাহা।

কবিতা তাঁর জীবনেরই প্রতিরূপ। সমস্ত জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন কবিতাকে ভালোবেসে, সমর্পণ করেছেন, সমর্পিত হয়েছেন, কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনোই। কবিতাকে আঁকড়ে থেকেছেন, আপস করে নয়, লড়াই করে। অনাহুত দুঃখের মাঝেও মহাদেব সাহা ডুবে থেকেছেন কবিতা সৌন্দর্যে।

‘অন্তর ভালো না, পুষ্প ভালো না’ কবিতায় সহজ উচ্চারণ—‘ভালো, তোমাদের সবকিছু ভালো,/শরীর স্বাস্থ্য ভালো, বেশভূষা ভালো/কথা ভালো, ততোধিক কপটতা ভালো,/কিন্তু হূদয় ভালো না, কিছুতেই না।’ আবার ‘সত্যভঙ্গ করেছে মানুষ’ কবিতায়—‘মানুষের হাত আজ কলঙ্কিত করেছে মানুষ/তুমি আর সেই হাতে জলস্পর্শ কখনো কোরো না,/মানুষ মেখেছে রক্ত, মানুষ ধরেছে বিষফণা/এই হাতে গোলাপ স্পর্শ আর কোরো না, কোরো না/মানুষের চোখ আজ কলুষিত করেছে মানুষ/...সত্যভঙ্গ করেছে মানুষ, মানুষ করেছে প্রতারণা/এই মুখে ভালোবাসি উচ্চারণ কোরো না, কোরো না’।

মহাদেব সাহা সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতনও। কবিতায় তিনি যেমন সমাজের অসংগতি, মানুষের নৈতিক স্খলন ইত্যাদি চিত্রিত করেছেন, তেমনি সহজ-সরল ঢঙে রচিত তাঁর রাজনৈতিক কবিতাগুলি পাঠে স্বদেশের প্রতি কবির ভালোবাসা, স্বজাতির মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সমাজ ভাবনা ও রাজনীতি সচেতনতা সহজেই অনুমেয়। দেশভাবনা প্রবলভাবে ঘিরে আছে এই কবিকে। তিনি নিজেই বলেন ‘আমি পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে গেছি, কিন্তু ঢাকার আকাশ ছাড়া আমি কবিতা লিখতে পারি না।’ স্বৈরাচার, সামরিক শাসন-নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির রাজনৈতিক উত্থান, জনকহত্য, রাষ্ট্রের সংকটময় সময়, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, মূল্যবোধের অবক্ষয় নানা অসংগতি চিত্রিত করেছেন কবিতায় শিল্পগুণ অক্ষুণ্ন রেখে। সহজ-সরল প্রাঞ্জল ভাষার কবিতাগুলি পাঠে পাঠকহূদয় অশ্রুসিক্ত আবেগী হয়ে ওঠে, কখনো হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। ‘অন্ধ’ কবিতায় তাঁর সোচ্চার উচ্চারণ—‘আমরা এমনি অন্ধ কিছুই দেখি না!’ আবার তিনি এ-ও বলেন, ‘আরো কতো নত হলো ফুল আর কতো বিদ্ধ হলো পাখি/আরো কতো আহত হলো ওরা,/...আরো কতো পাখির পালক ঝরার শব্দে উঠে গেলো গ্রাম/দেখো পাখি ও প্রকৃতির মতো শুদ্ধ আরো কতো মানুষ লুকালো।’ (কল্যাণকুশল হন্তা তোমাদের)।

মহাদেব সাহার কবিতার মর্মে মর্মে গাঁথা আছে পুনর্জাগরণের আহ্বান। ‘দেশপ্রেম’, ‘তোমার জন্য’, ‘স্বাধীনতার প্রতি’, ‘একদিন এই ঢাকা’, ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এই দুঃখী পাখি ও মানুষ’, ‘তারা বন্দী কেন’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘সেই কবিতাটি লেখা হয় নাই’, ‘জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর’, ‘আফ্রিকা তোমার দুঃখ বুঝি’, ‘অস্ত্র নয় ফুলই আজ অধিক জরুরি’, ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমি’, ‘অস্ত্র নয়, অহঙ্কার নয়’, ‘ফুল কই, শুধু অস্ত্রের উল্লাস’, ‘কী যেন বলতে চায় বন্দী স্বদেশ’—এসব কবিতায় বারবার প্রতিধ্বনিত জীবন, জীবনের সুধা-গন্ধ সংকট ও উত্তরণের গল্প ছড়িয়ে আছে।  এ-ই মহাদেব সাহার কবিতার সার্থকতা, কবি হিসেবে মহাদেব সাহার সার্থকতা।

দেশপ্রেম, রাজনীতিনিষ্ঠা মানুষের মুক্তির সরল পথ—এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন মহাদেব সাহা। ভালোবাসায় অসম্ভবকেও জয় করা যায়, পাঠকের মনে এই বিশ্বাস সঞ্চার করেছেন কবিতার মাধ্যমে। তাঁর কবিতা পাঠে একজন পাঠক আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসতে পারে, এরকম বাস্তব উদাহরণও আছে। মানুষের অসহায়ত্ব কবিকে বিচলিত করে তোলে; ‘মানুষের বুকে কেন মমত্ব দেখি না’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আজ কেন এতো হত্যা দেখি, রক্তপাত দেখি, চোখে কোনো অশ্রু দেখি না’। ব্যক্তি-অস্তিত্বের প্রসঙ্গ মহাদেব সাহা কবিতায় যেরূপে চিত্রিত করেছেন, সেখানে সমষ্টির চেতনাও সমানরূপে উপস্থিত। স্বদেশ ও ঐতিহ্য, জাতির শৌর্ষবীর্য আর সংগ্রামী চেতনা স্পর্শ করে তাঁর কবিতা, হূদয়ে উদ্দীপনা জাগায়, সম্প্রীতির প্রেরণা জোগায়।

 

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন