শুক্রবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ট্রেনে ছিনতাই ও ঢিল অরক্ষিত যাত্রীরা

*ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনায় চলন্ত ট্রেনে আতঙ্ক
*৯৭টি স্পট ভয়ংকর হিসেবে চিহ্নিত 
*যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও বন্ধ হচ্ছে না পাথর ছোড়া

আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১৭:৩০

চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পাথর ছোড়ার পাশাপাশি বাড়ছে ট্রেনে ছিনতাই। এতে একপ্রকার অরক্ষিত হয়ে ট্রেনে চলছে যাত্রীরা। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে যাতায়াতের সুযোগ করে দিতে বিভিন্ন কমিউটারসহ লোকাল ট্রেনকে যেখানে সেখানে স্টপেজ করানো হয়। রাতে কিংবা দিনে স্টেশন ছাড়া বিভিন্ন নির্জন স্থানে এসব ট্রেন ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মতো অপেক্ষা করে। এসব ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা বেশি থাকে, জানালা খোলা থাকে, অনেক যাত্রী ট্রেন থেকে নিচে নামে। এই সুযোগে ছিনতাইকারীরা যাত্রীদের মোবাইলসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ১০ আগস্ট রাতে টঙ্গী এলাকায় ঘটে এমন এক ঘটনা। ট্রেন থামানোর পর ছিনতাইকারীরা মোবাইল নিয়ে যায়। প্রতিবাদ করলে তারা তেড়ে এসে ট্রেনে অনবরত ঢিল  ছোড়া শুরু করে। এতে সাধারণ যাত্রীরা ভয় পেয়ে যায়।

১৯৮০ সালের রেলওয়ে আইনের ১২৭ ধারায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের জন্য ১০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১০ বছরের কারাদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হলেও পাথর ছোড়ার ঘটনা বন্ধ করা যায়নি। বরং এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। যাতে ট্রেনের চালক, সহকারী চালকসহ যাত্রীরা আহত হচ্ছেন। এমনকি জানালা বন্ধ রেখেও রেহাই মিলছে না, জানালার কাঁচ ভেঙে অনেকে আহত হন। পাথর নিক্ষেপকারী অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে সে ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের শাস্তির বিধান রয়েছে। এতসব আইন থাকার পরও কোনোভাবেই চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বন্ধ করা কেন যাচ্ছে না সেটিই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে চলন্ত ট্রেনে ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনায় যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রেলে নিরাপত্তাকর্মী থাকা অবস্থাতেই এধরনের ঘটনা মানুষকে রেল ভ্রমণের ব্যাপারে অনুত্সাহিত করে তুলছে। দেশের কেন্দ্রীয় রেল টার্মিনাল ঢাকার কমলাপুর থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী টঙ্গী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে  আসাযাওয়া করেন। সম্প্রতি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনে ডাকাতি ও যাত্রী হত্যার মতো আতঙ্কজনক ঘটনা ঘটে। যদিও এ ঘটনার পর র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও রেল পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসেছে। এধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছে, কিন্তু যাত্রীদের ভিতরের দুশ্চিন্তা তাতে দূর করা সম্ভব হয়নি।

সূত্র জানায়, রেলের ২ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটারের মধ্যে অরক্ষিত ৭০০ কিলোমিটার। যার মধ্যে ৯৭টি স্পট ভয়ংকর হিসেবে চিহ্নিত। যেখানে প্রতিনিয়ত ছিনতাই, ডাকাতি, ঢিল ছোড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। গাজীপুর  মেট্রোপলিটন পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দাঁড়ানো অবস্থায় ট্রেনে ছিনতাই ও ঢিল ছোড়ার ঘটনায় রাজধানীর টঙ্গী এলাকার আশপাশ  থেকে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সময় ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত চাপাতি, সুইসগিয়ার ও গুলতি উদ্ধার করা হয়। ছিনতাই করা মোবাইলও উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, এ ঘটনার পর ছিনতাইকারীরা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। জায়গাটি নির্জন হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সুযোগ পায় তারা।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মাহবুব রহমান জানান, যখন ট্রেন যায়, তখন  মেইল ট্রেনগুলোকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থামানো হয় এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোকে আগে যেতে দেওয়ার জন্য। যখন এসব মেইল ট্রেন বিভিন্ন জায়গায় থামে, তখন অনেক যাত্রী ট্রেন থেকে নিচে নামেন। এই সুযোগটাই ছিনতাইকারীরা নিয়ে থাকে। মাঝে মধ্যে দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে, এতে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিই। কিন্তু গত ১০ আগস্টের ঘটনাটা বড় আকার ধারণ করে। এখানে অপরাধী সংখ্যা  বেশি ছিল। তিনি বলেন, যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, তার আশপাশে বস্তি এলাকা। এ ঘটনায় ১০ থেকে ১১ জন জড়িত থাকতে পারে। সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

গত বছর ১৫ আগস্ট নীলফামারীর সৈয়দপুরে চলন্ত ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনায় পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে পাথর ছোড়ার অন্তত তিনটি পৃথক ঘটনায় আহত হয়েছেন তিন জন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ট্রেনে পাথর ছোড়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। এর ফলে যাত্রীরা আহত হচ্ছেন, পাশাপাশি অঙ্গহানি ঘটছে অনেকের। ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে ভাটিয়ারী এলাকায় চলন্ত ট্রেনে ছোড়া ঢিলে প্রীতি দাশ নামে এক প্রকৌশলীর নির্মম মৃত্যু হয়েছে।

গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চলন্ত ট্রেনে সবচেয়ে বেশি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম থেকে ঈশ্বরদী, টাঙ্গাইল থেকে মির্জাপুর, পার্বতীপুর থেকে নীলফামারী, খুলনা থেকে সৈয়দপুর এবং যশোর থেকে নওয়াপাড়া স্টেশন পর্যন্ত।

এদিকে দিনের চেয়ে রাতেই ট্রেনযাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় বেশি ভুগছেন। সম্প্রতি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী কমিউটার ট্রেনে ডাকাতি ও যাত্রী হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ও রেল পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে বেশ কয়েক জন ডাকাতকে আটক করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ব্যাপারে রেলওয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো মন্তব্য করেননি।

ইত্তেফাক/এমএএম