শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিংয়ের সঙ্গে কোনো শিক্ষক অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন বা বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রণীত নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (আবাসিক হলসহ) কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে বুলিং ও র্যাগিংয়ের ঘটনার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট রিপোর্ট করবেন। যদি এ ধরনের ঘটনা গোপন করেন তাহলে নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী হবেন। এছাড়া নীতিমালায় পাঁচ ধরনের বুলিং ও র্যাগিংকে সংজ্ঞায়িত করে তা হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে।
প্রণীত নীতিমালাটি গ্রহণ করে তা তিন মাসের মধ্যে দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ। একইসঙ্গে নীতিমালা পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বুলিং-র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আদালতের আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার কাজী মাইনুল হাসান।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেসব জায়গায় বুলিং ও র্যাগিং হওয়ার আশংকা থাকে, সেসব জায়গায় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থা করবে। এ ধরনের অপরাধে উৎসাহিত হয় এমন কোন কার্যকলাপ, সমাবেশ ও অনুষ্ঠান করা যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ নিয়মিত বুলিং ও র্যাগিং বিষয়টি পরীবীক্ষণ করবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্তৃপক্ষ ৩-৫ সদস্য বিশিষ্ট বুলিং-র্যাগিং প্রতিরোধ কমিটি গঠন করবে। প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষ এক বা একাধিক কমিটি গঠনের সুযোগ থাকবে। কমিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যা, বুলিং ও র্যাগিং সংক্রান্ত যে কোন ধরনের ইনজুরি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কমিটি ‘অভিযোগ বক্স’ বা ‘ডিজিটাল ড্রপ বক্স’ রাখবে এবং অভিযোগের গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
পাঁচ ধরনের বুলিং-র্যাগিংয়ের সংজ্ঞা
১. মৌখিক বুলিং-র্যাগিং: কাউকে উদ্দেশ্য করে মানহানিকর/অপমানজনক এমন কিছু বলা বা লেখা, যা খারাপ কোনো কিছুর প্রতি ইঙ্গিত বহন করে-ইত্যাদিকে মৌখিক বুলিং বোঝাবে। যেমন-উপহাস করা, খারাপ নামে সম্বোধন করা বা ডাকা, অশালীন শব্দ ব্যবহার করা, গালিগালাজ করা, হুমকি দেওয়া, শারীরিক অসমর্থতাকে নিয়ে উপহাস করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
২. শারীরিক বুলিং ও র্যাগিং: কাউকে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করা, চড়-থাপ্পড় মারা, শরীরে পানি বা রং ঢেলে দেওয়া, লাথি মারা, ধাক্কা মারা, খোঁচা দেওয়া, থুথু দেওয়া, বেঁধে রাখা কোনো বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে/বসে বা বিশেষ অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া অথবা কোনো কিছু করতে বা না করতে বাধ্য করা, কারো কোনো জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যাওয়া বা ভেঙে ফেলা, মুখ বা হাত দিয়ে অশালীন বা অসৌজন্যমূলক অঙ্গভঙ্গি করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
৩. সামাজিক বুলিং ও র্যাগিং: কারো সম্পর্কে গুজব ছড়ানো, প্রকাশ্যে কাউকে অপমান করা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র, পেশা, গায়ের রং, অঞ্চল বা জাত তুলে কোনো কথা বলা বা অনুরূপ কার্যাদি।
৪. সাইবার বুলিং-র্যাগিং: কারো সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটু কিছু লেখা বা ছবি বা অশালীন ব্যঙ্গাত্মক কিছু পোস্ট করে তাকে অপদস্থ করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
৫. সেক্সুয়াল বুলিং ও র্যাগিং: ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিজনক স্পর্শ করা বা করার চেষ্টা করা, ইঙ্গিতবাহী চিহ্ন প্রদর্শন করা, আঁচড় দেওয়া, জামা-কাপড় খুলে নেওয়া বা খুলতে বাধ্য করা বা অনুরূপ কার্যাদি।
এই পাঁচ ধরনের বুলিং-র্যাগিং ছাড়াও এমন কর্ম, আচরণ, কার্যাদি যা অসম্মানজনক, অপমানজনক ও মানহানিকর এবং শারীরিক/মানসিক যাতনার কারণ হতে পারে, তা যে নামেই হোক না কেন, তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
যেভাবে হবে অভিযোগের নিষ্পত্তি
অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট আবেদন দেবে। বুলিং-র্যাগিংয়ের অভিযোগ পেলে কমিটি গঠন করে তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান। তদন্ত দল সর্বোচ্চ সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করবে। প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট তা উপস্থাপন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন প্রতিষ্ঠান প্রধান।
প্রসঙ্গত, বিবিসি বাংলায় ‘মোটা বলে সহপাঠী ও শিক্ষকের লাঞ্ছনার শিকার মৃত কিশোরের পরিবার যা বলছে’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এছাড়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের ছাত্রী অরিত্রি অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনা নজরে আসার পর হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বুলিং প্রতিরোধের উপায় নির্ণয় করে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করার নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে অবশেষে সোমবার ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং ও র্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২৩’ চূড়ান্ত করে হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। আদালতে রিটকারী পক্ষে আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা, অনীক আর হক ও তানভীর আহমেদ এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান শুনানি করেন।