সোমবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আনারস বাগানে একদিন

আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১৮:২৫

ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটা বেজে দশ মিনিট। লিলু ভাই এসে উপস্থিত;  যাব নতুন গন্তব্যে। কিছুদিন আগে লিলু ভাই সন্ধান দিয়েছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ দত্তরাইল গ্রামে অবস্থিত আনারস বাগানের। আমরা আজ চলছি ঢাকাদক্ষিণ দত্তরাইল গ্রামের পানে। সিলেটে আনারস বলতেই বুঝানো হতো শ্রীমঙ্গল অথবা বিয়ানীবাজারের জলঢুপ।

তবে, গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণের ‘আব্দুল মতিন চান মিয়া চেয়ারম্যান’ আনারস বাগান বদলে দিয়েছে সেই ধারণা। সেই বাগানের সুবাদে গোলাপগঞ্জ এখন আনারসের দেশ। চান মিয়া চেয়ারম্যানের আনারস বাগান ঘিরে চলছে আনারস উত্সব। রসালো আনারসের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। বাগান থেকে আনারস সংগ্রহ, বিক্রি এবং দর্শনার্থীদের ভিড়ে বাগান এলাকায় বিরাজ করছে অন্য রকম পরিবেশ। কথাগুলো আগেই শুনিয়ে ছিলেন আমাদের পাইলট লিলু ভাই। 

আজ অবশ্য আকাশের মন ভালো নেই। তাই কিছু সময় পর পর কান্না করছে। পিচঢালা পথ পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলছি গন্তব্যের পথে। পথিমধ্যে আমাদের বাহন থামিয়ে দেওয়া  হলো। আর সামনে যাওয়া যাবে না। পথে দীর্ঘ যানজট দেখতে পেলাম,  সাবাই আনারস বাগান অভিমুখী।  আমাদের মতো অনেকেই ঘুরতে যাচ্ছে এই আনারস বাগানে। আমরা পদব্রজে এগিয়ে চলছি। এদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাই দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। চারপাশে উঁচু-নিচু টিলা। আমরা বাতাসে পাচ্ছি পাকা আনারসের ঘ্রাণ! ডানপাশে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, তাতে লেখা— ‘আব্দুল মতিন চান মিয়া আনারস বাগান’।

আমরা এসে উপস্থিত হলাম প্রবেশদ্বারে। শত শত মানুষ এগিয়ে চলছে আনারস বাগানের দিকে। আমরাও চললাম এগিয়ে। উঁচু-নিচু টিলার বুক চিরে সারি সারি সাজানো গোছানো আনারস বাগান। থোকা থোকা গাঢ় সবুজের ডানা মেলেছে ছোট-বড় হাজারো কাঁচা-পাকা আনারস। পথিমধ্যে কথা হলো স্থানীয় অধিবাসী মুরাদ ভাইয়ের সাথে । তিনি বলেন, ‘প্রায় ৬০ কের (১৮ একর) জায়গা নিয়ে পারিবারিকভাবে করা এ আনারস বাগান । ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের দু’বারের চেয়ারম্যান মরহুম আব্দুল মতিন চাঁন মিয়ার সন্তানেরা এর দেখভাল করেন। বৃহত্ আকারে গোলাপগঞ্জে এটিই একমাত্র আনারসের বাগান। জলঢুপী জাতের এ আনারসের বাগানটি দত্তরাইল গ্রামে গড়ে উঠে ২০১৯ সালে। টিলার তুলা বাগানে এখন প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার আনারসের চারা গজিয়েছে। কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়া প্রায় ১৮ মাস পরিচর্যার পর এখন চলছে বিক্রি। গড়ে  প্রতিদিন ৪-৫ হাজার পাকা আনারস বিক্রি হচ্ছে। তবে এ আনারস বিক্রি করে আয়ের সব টাকা জমা হচ্ছে মরহুম আব্দুল মতিন চাঁন মিয়ার নামে গঠিত ‘আব্দুল মতিন চাঁন মিয়া এডুকেশন ট্রাস্টে’। যে ট্রাস্ট শিক্ষাসহ এলাকার অসহায় মানুষের কল্যাণে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে যাচ্ছে।’

যেদিকে চোখ যায় কেবল আনারস! কাঁচা, পাকা, আধা-পাকা আনারস। আর এসব আনারস সংগ্রহ করছেন অসংখ্য শ্রমিক। সারি সারি আনারস গাছ আর চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। এক টিলা থেকে অপর টিলার ঢালু বেয়ে আনারস গাছের সারিতে চোখ জুড়িয়ে যায়। তপ্ত রোদেও সেখানে আছেন শত শত দর্শনার্থী। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই আরেক দৃশ্য। সূর্যের তাপ কমার সঙ্গে সঙ্গে পড়ন্ত বিকেলে বাড়তে থাকে দর্শনার্থীর ভীড়। উঁচু-নিচু টিলার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা সড়কের উভয়পাশই যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা স্বপ্নের রাজ্য। মেঘলা আকাশ পুরো এলাকা আরও বেশি উপভোগ্য করে তোলে। এদিকে দীর্ঘ সময় পদব্রজে থাকার পর আমরা নেমে এলাম সমভূমিতে। দেখতে পেলাম আব্দুল মতিন চাঁন মিয়ার বাড়ির সামনে বাগানের প্রবেশপথের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে জুস কর্নার ও একটি বিশ্রামাগার। আর সেই জুস কর্নারে বাগানের আনারস কেটে বিক্রি করা হচ্ছে। ১০ টাকা, ৫ টাকা বা যার যেমন চাহিদা কেটে রাখা আনারস খাচ্ছেন। আবার এখানে একটি ক্যাশ কাউন্টার রেখে আনারস বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বাগান দেখে বাড়ি ফেরার সময় দর্শনার্থীরা পরিবার-পরিজনের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন আনারস। আকারভেদে রাখা হচ্ছে আনারসের দাম। ৮০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৮০ টাকা পর্যন্ত হালিতে আনারস বিক্রি হচ্ছে। সবুজ প্রকৃতি দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। তাই তো ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে চাঁন মিয়ার আনারস বাগানসহ আশপাশের এলাকা হতে পারে একটি দর্শনীয় স্থান। বাগান থেকে ছোট পাকা সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে বিএনকে স্কুল পর্যন্ত সড়কের উভয়পাশে দেখা যায় নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিংবা কোথাও গাড়ি থামিয়ে সড়কের পাশে খানিক সময় বসে থাকলে নীরব প্রকৃতি আপনাকে সঙ্গ দেবে নিঃসন্দেহে। সেই সঙ্গে এলাকার মানুষের বন্ধুসুলভ আচরণও আপনাকে মুগ্ধ করবে।

যেভাবে যাবেন

সিলেটের কদমতলি থেকে গোলাপগঞ্জ সড়ক হয়ে ঢাকাদক্ষিণে যাওয়ার ১ কিলোমিটার আগে ডান পাশে ব্র্যাক অফিস। এর পাশ দিয়েই প্রবেশ করেছে বিএনকে সড়ক। সিলেট থেকে অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া ৪০ টাকা। আর বাসে গেলে ৩০ টাকা। এখানে নেমে পায়ে হাঁটলে ১০ মিনিট, আর গাড়িতে করে গেলে ২ থেকে ৩ মিনিট। চাইলে সিলেট থেকে রিজার্ভ গাড়িও নিতে পারেন। সারা দিনের জন্য অটোরিকশার ভাড়া সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা, আর মাইক্রোবাস হলে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০০-১ হাজার ৮০০ টাকা ভাড়া নিতে পারে।

ইত্তেফাক/আরএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন