শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

'জুমা ও জানাজার নামাজে মুসল্লিদের মোবাইল ফোন চুরি করতো চক্রটি'

আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৫৩

মসজিদে-মসজিদে জুমার নামাজ বা জানাজার নামাজে মোবাইল চুরির উদ্দেশে ঘুরে বেড়ায় তারা। জনসমাগম ঘটলেই সন্তর্পণে মোবাইল হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে। মুসল্লিদের নামাজে মগ্ন থাকার সময়টাই তাদের কাজের সময়।

সম্প্রতি এমনই এক চক্রের ৯ সদস্যকে আটক করেছে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারোর মৃত্যুর খবর দেখলে তারা জানাজার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ওই স্থানে বা মসজিদে উপস্থিত হতো। 'বডি কাজ' নামে তারা নিজেদের মধ্যে এই চুরির কোডনেম ব্যবহার করতো।

গ্রেপ্তার হওয়া চোর চক্রের সদস্যরা হলো— বাহাউদ্দিন হোসেন মিজি ওরফে বাহার, রমজান আলী, হামিম আহমেদ ওরফে হামিম, আতিকুল ইসলাম, পারভেজ হাসান, মাসুদুর রহমান ওরফে মাসুদ, সাইফুল ইসলাম, ফয়সাল আহমেদ রনি ও মিল্লাত হোসেন। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বারিধারায় এটিইউ-এর প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির পুলিশ সুপার (অপারেশন, মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন।

সংবাদ সম্মেলনে এটিইউ-এর পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন। ছবি: এটিইউ

তিনি জানান, রাজধানীর চানখাঁরপুল, জুরাইন বিক্রমপুর প্লাজা ও বুড়িগঙ্গা সেতু মার্কেট, যমুনা ফিউচার পার্কসহ কয়েকটি এলাকায় বুধবার অভিযান চালিয়ে এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে তিনটি ল্যাপটপ, একটি মনিটর, একটি রেডমি নোট-১২ প্রো সহ ৭টি মোবাইল ফোন সেট, কম্পিউটার সামগ্রী এবং মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের কাজে ব্যবহৃত ১৬টি ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে।

পুলিশ সুপার ছানোয়ার আরও জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোর বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল ও জানাজার নামাজসহ জনসমাগমস্থল থেকে মোবাইল ফোন চুরি করতো। এরপর চোরাই মোবাইল সেটের আইএমইআই পরিবর্তন করে কেনা-বেচা করতো তারা। আইএমইআই নম্বর বদলে ফেলার ফলে ওই ডিভাইস আর ট্র্যাক করা সম্ভব হতো না।

জানা যায়, জানাজার খবর পেলে ওই চক্রের সদস্যরা পাজামা-পাঞ্জাবি ও টুপি পরে সেখানে গিয়ে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে যেতো। প্রতিটি গ্রুপে তিনজন করে সদস্য চুরি সম্পন্ন করতো। ভিড়ের মধ্যে তাদের একজন কৌশলে কারোর পকেট থেকে মোবাইল ফোন চুরি করে গ্রুপের দ্বিতীয় সদস্যকে দেয়। দ্বিতীয় সদস্য সেটি আবার তৃতীয় আরেকজনকে দেয়। মোবাইল হাতে পাওয়ার পরপরই তৃতীয় ব্যক্তি জানাজার স্থান ছেড়ে সটকে পড়ে। এভাবে যার মোবাইল চুরি হয়, তিনি টেরও পান না।

পুলিশ সুপার ছানোয়ার বলেন, 'জানাজা ছাড়াও চক্রটির টার্গেট থাকে জুমার নামাজ। বেশি মুসল্লির আগমন ঘটে এমন মসজিদগুলোতে চক্রটির সদস্যরা তিনজনের গ্রুপ করে অবস্থান নেয়। নামাজের কাতারে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে একই কায়দায় মোবাইল ফোন চুরি করতো ওরা। এই চুরিকে ওরা ‘মসজিদ কাজ’ বলে। চক্রটির সবচেয়ে বেশি গ্রুপ সক্রিয় থাকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে।”

তিনি বলেন, ‘চক্রের সদস্য বাহার তাদের গ্রুপগুলো থেকে চোরাই মোবাইল সেট সংগ্রহ করতো। বাহারের একজন মোটরসাইকেল চালক আছে। বাহারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সে গ্রুপগুলো থেকে মোবাইল সেট সংগ্রহ করে সেগুলো মাসুদের কাছে পাঠিয়ে দিতো। আর মাসুদের কাজ ছিল চোরাই মোবাইল সেটগুলো নির্দিষ্ট দোকানে পৌঁছে দেওয়া।’

এটিইউ জানায়, তদন্তে তিনটি দোকানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেগুলোতে এই চক্র চোরাইল মোবাইল সেট পৌঁছে দিয়ে থাকে। সেগুলো হলো- জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার এসআই টেলিকম, যার মালিক গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল; জুরাইনের সেতু মার্কেটের ফয়সাল টেলিকম, যার মালিক গ্রেপ্তার হওয়া ফয়সাল এবং যমুনা ফিউচার পার্কের চতুর্থ তলার একটি দোকান, যার মালিক গ্রেপ্তার হওয়া মিল্লাত।

‘এসব দোকানে মোবাইল সেট মেরামত ও বিক্রির কাজ চলে। দোকানে আসার পর প্রথমেই মোবাইল সেটগুলোর আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করা হয়। পরে সেটগুলোর প্যাটার্ন লক খোলা হয়। সবশেষে ল্যাপটপের মাধ্যমে ডিভাইস ফ্ল্যাশ করে মোবাইল সেটগুলো বিক্রি করা হয়।’

গ্রেপ্তার হওয়া আরিফ। ছবি: এটিইউ

এদিকে পৃথক এক অভিযানে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক সদস্যকে আটক করেছে। তার নাম মোহাম্মদ আরিফ। সে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার ফেকামারা এলাকার মো. হানিফের ছেলে। বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে থেকে আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এটিইউ জানিয়েছে, আরিফ ও তার সহযোগিতা দেশে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। ২৩ বছর বয়সী আরিফ টঙ্গীর চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো।

এ বিষয়ে এটিইউ-এর পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন জানান, গ্রেপ্তারকৃত আরিফ ১৫-২০ দিন আগে বিদেশ থেকে কিছু জঙ্গি আসবে বলে একটি ফোন পান। বিদেশ থেকে ওই জঙ্গি দল আসার পর আরিফসহ টঙ্গী এলাকায় একটি মিটিং (বৈঠক) করার কথা ছিল। পরিকল্পনা ছিল, বৈঠক শেষে তারা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাবে। ইয়াকুব হুজুর নামে অপর একজন জঙ্গির সহযোগী হিসেবে কাজ করছিলেন আরিফ। এছাড়া এই পরিকল্পনার সঙ্গে ওমর ফারুক ও জাহাদ খান নামে আরও দুই জঙ্গি জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য এটিইউ-এর হাতে আসার পর বুধবার ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়।’

এটিইউ-এর এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘১৫-২০ দিনে আগে ইয়াকুব হুজুরের কাছ থেকে ফোন পান আরিফ। ফোন করে ইয়াকুব জানান, বিদেশ থেকে সংগঠনের আরও কিছু সদস্য আসবে। পরে তারা সবাই টঙ্গী এলাকায় একত্রিত হয়ে গোপন বৈঠক করবে এবং পরে নাশকতার বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য পাওয়ার পর আমরা নজরদারি বৃদ্ধি করি। নজরদারির এক পর্যায়ে মনে হয়েছে তারা কোনো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে এই বৈঠক করতে চাচ্ছে। পরে গতকাল অভিযান চালিয়ে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্যদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।'

মোহাম্মদ আরিফ এবং পলাতক আসামী ইয়াকুব হুজুর, ওমর ফারুক ও জাহাদ খানসহ তাদের অজ্ঞাতনামা সহযোগী আসামিদের বিরুদ্ধে টঙ্গী থানায় মামলা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

ইত্তেফাক/এসটিএম