মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

জাতিসংঘের সংস্কার কি সম্ভব!

আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:০৭

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশন্স তৈরি হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সেটি বিশ্বকে রক্ষা করতে ব্যর্থতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার প্রেক্ষাপটই জাতিসংঘের মতো সংস্থার ভিত্তি রচনা করেছিল। তবে যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে রক্ষা আর সার্বভৌম দেশগুলোর মধ্যে সমতামূলক নিরাপত্তার আদর্শিক ভাবনা থকে জাতিসংঘের জন্ম হলেও সংস্থাটির জন্মের পরেও অনেকগুলো যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। মানবাধিকার ও মানবিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এই সংস্থাটি। গত দুই তিন দশকের বেশি সময় ধরে এর সংস্কারের দাবি উঠেছে। কিন্তু সংস্কার আদৌ হবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এবারের সম্মেলনেও জাতিসংঘ মহাসচিবসহ সংস্থাটি মোড়লরাই সংস্কারে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এটা ঠিক যে, যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায় তারা কি আসলে জাতিসংঘকে কার্যকর করতে চায় না কি কেবলই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায় সেটাই মূল প্রশ্ন।

কারা সংস্কার চায় এবং কী দাবি: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায় জার্মানি, জাপান, ভারত ও ব্রাজিল। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক জানিয়েছেন, জাতিসংঘের সংস্কার প্রয়োজন। বেয়ারবক বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে কথা হয়েছে। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে এ বিষয়ে আলোচনায় তিনি সম্মত হয়েছেন।’ জি-৪ এর দেশগুলোর সঙ্গে একটি বৈঠকেও যোগ দিয়েছিলেন বেয়ারবক। ভারত, ব্রাজিল, জার্মানি এবং জাপানকে জি-৪ দেশ বলা হয়। এরা সবাই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এর জন্য একে অপরকে সাহায্যও করে দেশগুলো। তাদেরই বৈঠক ছিল গত বৃহস্পতিবার। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে দেশগুলোর প্রতিনিধিদের। তুরস্ক নিরাপত্তা পরিষদের এমন একটি কাঠামো চায় যাতে দেশটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ভেটো ক্ষমতা ছেড়ে দিতেও চায়।

জি-৪ বিশ্বাস করে যে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অস্থায়ী সদস্যদের মনোনয়ন এবং নির্বাচনের সময় ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাজ্য (এসআইডিএস)সহ ছোট এবং মাঝারি আকারের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কথা যথাযথভাবে বিবেচনা করা উচিত। তাছাড়া সংস্কারকৃত নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকান প্রতিনিধির ব্যাপারেও পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে জি-৪। ন্যায়সম্মত ভৌগোলিক বণ্টন এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব ধারণার ওপর জোর প্রদান করে জি-৪। কারণ ন্যায়সঙ্গত ভৌগোলিক বণ্টন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার একটি ভিত্তি। একই সঙ্গে বৈধতা এবং কার্যকারিতার জন্য এটি প্রয়োজনীয়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে: নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যারা হতে চায় তারা মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ এবং নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখতে চায়। তারা চায় যে, এসব সিদ্ধান্তে যেন কোনো দেশের একক ভেটো ক্ষমতা কার্যকর না হয়। বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদেশ (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স ও ব্রিটেন)  প্রত্যেকেরই ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। একটি প্রস্তাবে একটি রাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করলেই সেই প্রস্তাব পাশ হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে দুর্গতি যা হওয়ার তাই হয়। এই যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে প্রস্তাব পাশের চেষ্টা হলেও চীন ও রাশিয়ার বাধায় সেই প্রস্তাব আলোর মুখে দেখেনি। ফলে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ মরার পাশাপাশি সারা বিশ্বকে এই মূল্য চোকাতে হচ্ছে। আবার সিরিয়ায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলেও নিরাপত্তা পরিষদে সেটি পাশ হয়নি। ফলে সিরিয়ায় ৬ লাখ মানুষের জীবন যায় এবং ১ কোটির বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

সংস্কার কি আদৌ সম্ভব?: জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে নিরাপত্তা পরিষদের সবগুলো স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রই এবারের জাতিসংঘ সম্মেলনে সংস্কারের কথা বলেছেন। কিন্তু তারপরও এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ নেতারা মুখে যা বলেন তা যে বাস্তবে পরিণত করেন না সেটাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৯০-এর দশক থেকে জাতিসংঘের সংস্কারের দাবি উঠেছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা সীমিত করারও দাবি উঠেছে। কিন্তু এসব প্রভাবশালী রাষ্ট্র কি তাদের ভেটো ক্ষমতা কমানোর প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবে? এক কথায় বলতে গেলে ‘না’। যারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায় তাদের (সংক্ষেপে এদেরকে আর-৭ নাম দেওয়া হয়) এবং বর্তমান সদস্যদের আর্থিক ও সামরিক তুলনা আলোচনা করলেই সংস্কার সম্ভব কি না, তা জানা যাবে। ১৯৯০-এর দশকে যে সাতটি দেশ সংস্কারের দাবি করেছিল তারা বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১২ জিডিপি তালিকার মধ্যে। ঐ সময় এই দেশগুলোর জিডিপি পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের মোট জিডিপির ৭৭ দশমিক ৫ ভাগ ছিল। ২০২২ সালে সেই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ যা অবনতি।

বলা ভালো যে, স্থায়ী সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে অর্থ প্রথম শক্তি। দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে সামরিক ব্যয়। ১৯৯০-এর দশকে আর-৭ এর সামরিক ব্যয় ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ২০২২ সালে এসে সেটা কমে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে জাতিসংঘ বাজেটে আর-৭ ভুক্ত দেশগুলোর অবদান স্থায়ী সদস্যরাষ্ট্রের চেয়ে কমেছে। ২০২২ সালে তাদের অবদান ৪৫ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

আঞ্চলিক সমস্যাও রয়েছে। এই ধরনের সংস্কারে ঐতিহ্যগতভাবে কিছু ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠী দ্বারা বিরোধিতা করা হয়, যা মূলত জি-৪-এর আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগী দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। এই দলটির নেতৃত্বে রয়েছে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যরা ছাড়াও পাকিস্তান (ভারতের বিরোধী), ইতালি ও স্পেন (জার্মানের বিরোধী), মেক্সিকো, কলম্বিয়া, এবং আর্জেন্টিনা (ব্রাজিলের বিরোধিতা) এবং দক্ষিণ কোরিয়া (জাপানের বিরোধিতা)। ১৯৯২ সাল থেকে ইতালি ও গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যরা এর পরিবর্তে আধা-স্থায়ী আসন বা অস্থায়ী আসনের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

ইত্তেফাক/এএইচপি