রোববার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতির ভাইয়ের বিরুদ্ধে ‘টর্চার সেলে’ শিক্ষার্থী নির্যাতনের অভিযোগ

আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:১৬

সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের ছোট ভাই আরমান খান যুব’র বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) এক শিক্ষার্থীকে ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। 

বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা দেন ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম জাহিদ হাসান ইমন। জাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের (৪৬তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ও জাবি ছাত্রলীগের উপ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী  পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

অভিযুক্তরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (৪১তম ব্যাচ) সাবেক শিক্ষার্থী আরমান খান যুব, ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের (৪২তম ব্যাচ) আরাফাত, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (৪৫তম ব্যাচ) তুষণ ও অজ্ঞাত আরেক ব্যক্তি। 

এদের মধ্যে, আরমান খান যুব কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ের আপন ছোটভাই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪১তম ব্যাচের ‘র‌্যাগের রাজা’ বলে পরিচিত। এছাড়া কয়েকবছর আগে ছাত্রত্ব শেষ হলেও তিনি হলের মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষ দখল করে রেখেছেন।

জানা যায়, গত ১৩ আগস্ট সাভারের রেডিও কলোনীর বউবাজার এলাকার ভাড়া বাসার মালিকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় ইমনের। ওই ঘটনায় বাড়িওয়ালা ইমনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। এর কিছুক্ষণ পর বাড়িওয়ালা পূর্বপরিচিত আরাফাত ইমনকে ফোন দিয়ে আরমান খান যুবর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। তখন ইমন যুবকে কল করলে, তাকে মওলানা ভাসানী হলের সামনে যেতে বলেন যুব।

রাত ১২টার দিকে ইমন সেখানে গেলে, যুব তাকে মোটরসাইকেল হলের ভেতরে রেখে ১২৬ নম্বর কক্ষে যেতে বলে। এরপর কক্ষে ঢুকতেই ঘুষি মেরে ইমনের নাক ফাটিয়ে দেয় যুব। তখন যাতে চিৎকার করতে না পারে, তাই ইমনের মুখ বেঁধে দেয় আরাফাত। পরে যুব, আরাফাত ও তাদের সহযোগীরা ইমনকে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। এ সময় ইমন তাদের কাছে অনুরোধ করেও রক্ষা পাননি। তাকে একদফা মারধরের পর ইয়াবা সেবন করেন যুব। পরে আবারও ইমনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে তারা। এছাড়া ইমনের শরীরে মদ ঢেলে উল্লাস করতে থাকে যুব ও তার সহযোগীরা।

এরপর রাত তিনটার দিকে ইমনকে হলের দ্বিতীয় তলার ২২৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তুষণ নামে এক অভিযুক্ত তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসতে বলে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলকে গালাগালি করেছেন বলে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেন। এমনকি সেটা মুঠোফোনে ভিডিও ধারণ করে রাখে তুষণ। এরপর তাকে ফের ১২৬ নম্বর কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় মারধরের ঘটনা কাউকে না জানাতে ইমনের পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি দেন অভিযুক্তরা। কিছুক্ষণ পর আকতারুজ্জামান সোহেল ওই কক্ষে গিয়ে ইমনকে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও ইমনকে আশ্বাস দেন।

ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসানকে অবহিত করেন ভুক্তভোগী ইমন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মারধরের বিষয়ে জানাতে ১৪ আগস্ট সকালে প্রক্টরের বাসায় যান তিনি। তবে ইমন সেখানে গিয়ে দেখেন আকতারুজ্জামান সোহেল আগে থেকেই প্রক্টরের বাসায় অবস্থান করছেন। এ সময় ইমনকে মওলানা ভাসানী হলের অতিথি কক্ষে (গেস্টরুম) গিয়ে বসতে বলেন তিনি। তখন ইমন প্রক্টরের ওপর ভরসা না পেয়ে তার বাসা থেকে চলে যান। এরপর তিনি মারধরের বিষয়টি আল নাহিয়ান খান জয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের জানান।

এদিকে আরমান খান যুবর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের সিন্ডিকেট ও মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে ‘টর্চার সেল’ পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রত্ব শেষ হলেও হলের ওই কক্ষে তিনি অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এমনকি সেখানে বহিরাগতদের নিয়ে নিয়মিত মাদকসেবন করেন যুব। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ী ও বহিরাগতসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে টর্চার করেন তিনি। এর আগে, গত ১০ সেপ্টেম্বর বহিরাগত এক যুবককে ১২৬ নম্বর কক্ষে এনে মারধর করেন যুব। তার মারধরের শিকার হয়ে ওই যুবক ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ করতে থাকেন।

ভুক্তভোগী জাহিদ হাসান ইমন বলেন, আমাকে মারধর পরবর্তী নানা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের উপর আমার ভরসা উঠে যায়। পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগ দেইনি। তবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের জানিয়েছি। তবুও বিচার না পেয়ে কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছি। কারণ ওই রাতের ঘটনায় আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরমান খান যুব ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।

মওলানা ভাসানী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুসাইন মো. সায়েম বলেন, হলের ১২৬ নম্বর কক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা থাকে, সে বিষয়টি জানি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষকে জানিয়েছি। তবে মারধরের ঘটনা আমি জানিনা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান একাধিকবার তাকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

ইত্তেফাক/এবি