ভারত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত পর্যটনের লীলাভূমি। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ তার অনিন্দ্যসুন্দর সৈকত, কোরাল রিফ আর সামুদ্রিক প্রাণিবৈচিত্র্যের জন্যই পরিচিত। এই সৌন্দর্য যে সত্যিই আছে দেশটির তা নিয়ে কারো মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে এই সৌন্দর্যকে কে করায়ত্ব করবে তা নিয়েই যত দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বটা প্রতিবারের নির্বাচনে টের পাওয়া যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
নির্বাচন মালদ্বীপে হলেও দুই শীর্ষ প্রতিবেশীর মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল। দেশটিতে শনিবারের দ্বিতীয় দফার ভোটে বিরোধী দল জয় পেয়েছে। সরকারি দল হার মেনেছে। ১ হাজার ২০০ প্রবাল দ্বীপ আর অ্যাটল নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিরা প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। তাই তাদের জয়-পরাজয় স্বীকারের প্রশ্নও উঠেনি।
গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার নির্বাচনে কোনো প্রার্থীই জয়ী হওয়ার মতো পর্যাপ্ত ভোট না পাওয়ায় শীর্ষ দুটি দলের মধ্যে রানঅফ ভোট হওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিল দেশটির নির্বাচন কমিশন। ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার সেই ভোটগ্রহণ হয়। এতে বিরোধী প্রার্থী মোহামেদ মুইজ্জু জয় পান। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ্ পরাজয় স্বীকার করে মোহামেদ মুইজ্জুকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তবে উল্লেখ করার বিষয় এই যে, মুইজ্জু জয়ী হওয়ার পরই সরকারের প্রতি সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে ইয়ামিন ১১ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
জয়-পরাজয়ের কারণ: প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স কোয়ালিশনের নেতা মুইজ্জু ৫৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং মালডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা সোলিহ্ ৪৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে প্রথম দফার ভোটে কেউই ৫০ শতাংশ ভোট অর্জন করতে না পারায় দ্বিতীয় দফার ভোটে গড়ায়। কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, মালদ্বীপে ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচন চালু হয়। এরপর থেকে এই প্রথম দেশের জনগণ কতৃত্ববাদী সরকারের বিপক্ষে একটি উদার গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে ভোট দিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সোলিহ জয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার তিনি জিততে পারেননি।
মালদ্বীপের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক আহমেদ শাহিদের মতে, মালদ্বীপের রাজনৈতিক পটভূমিতে এটা একটা বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। তিনি বলেন, সোলিহের এমডিপি গণতন্ত্রের দল হিসেবে এসেছে, যখন পিপিএম সবসময় ঐতিহ্য এবং কর্তৃত্বের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু জনগণ এবার দুটি দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করেনি। তারা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আহমেদ শাহিদের মতে, সোলিহ তার অঙ্গীকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বড় বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারি এবং আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ও ব্লগার হত্যার বিচার করার অঙ্গীকার রক্ষা করেননি।
বিদেশিদের লড়াই: ব্রিটেন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানায়, মালদ্বীপের এবারের ভোটে ভারত এবং চীনের উপস্থিতি থাকছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট পদের দুই দাবিদার একেকটি আলাদা এশীয় শক্তিরও প্রতিনিধিত্ব করছেন। একজন চীনের, অন্যজন ভারতের। ২০১৮ সালে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর সোলিহ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশ শক্তিশালী করেছেন। ভারতের সঙ্গে তার দেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও খুব শক্তিশালী। আর মুইজ্জু আবার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ওপরেই জোর দিচ্ছেন।
তাদের কাছে মালদ্বীপ কেন গুরুত্বপূর্ণ: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে দিয়ে যে জাহাজ চলাচলের রুট আছে, তার মাঝামাঝি খুব কৌশলগত অবস্থানে থাকা মালদ্বীপে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে ভারত ও চীন প্রবল চেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে অপার সৌন্দর্য্যের দ্বীপের মালা খ্যাত রাষ্ট্রটি। প্রথম স্বীকৃতি দেওয়ার একটি রাষ্ট্র ছিল ভারত। এরপর থেকে ভারত প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে। অন্যদিকে ২০১১ সালের আগে মালদ্বীপে কোনো দূতাবাস ছিল না চীনের। যদিও ১৯৬৬ সালে তাইপে ভিত্তিক চীনা জাতীয়তাবাদী সরকার মালেতে একটি দূতাবাস খুলেছিল। তখন চীনারা মালদ্বীপে একটি কূটনৈতিক অফিস স্থাপনকারী প্রথম দেশ হয়ে ওঠে। এই অফিসটি বর্তমানে চীনের দূতাবাস দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। মহাপ্রাচীরের দেশটি যখন আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্য বাড়াতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরইআই) কর্মসূচি হাতে নেয় তখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে এশিয়ার অন্যতম ছোট দেশ মালদ্বীপ।
মালদ্বীপের পাশ দিয়ে চীনের সঙ্গে ইউরোপ ও আফ্রিকার জাহাজ-যোগাযোগের প্রাচীন সমুদ্রপথটি বিবেচিত হতে শুরু করে ‘গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ’ হিসেবে। সাগরপথে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের ও জ্বালানি আমদানির অনেকাংশই পরিবহন করা হয় মালদ্বীপের পাশ দিয়ে। একইভাবে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে সাগরপথে চীন যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি করে তার বেশির ভাগই পরিবহন করা হয় মালদ্বীপের পাশ দিয়ে। ফলে ছোট দেশ হয়েও মালদ্বীপ এশিয়ার দুই শক্তিশালী দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
চীন মালদ্বীপের যে মেগা-প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করছে তার অন্যতম হল ২ দশমিক ১ কিলোমিটার লম্বা একটি চার লেনের সেতু, যা রাজধানী মালের সঙ্গে পাশের একটি অন্য দ্বীপে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করছে। ২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত ঐ সেতুটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৮ সালে। ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে অধ্যাপক ও মালদ্বীপ বিশেষজ্ঞ আজিম জাহির সম্প্রতি বিবিসিকে বলেন, ‘মালদ্বীপের মানুষ আসলে মনে করে কোনো দেশের সঙ্গেই আমাদের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক রাখার দরকার নেই, এমন কী ভারতও নয়।’