ভোলার মনপুরায় লক্ষাধিক মানুষ বিদ্যুতের আলো থেকে বঞ্চিত। সরকার দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতাভুক্তির ঘোষণা দিলেও এখনও বিদ্যুৎ পায়নি মনপুরাবাসী। ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুত দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু উপজেলার প্রধান শহর ও উপজেলার আশপাশের এলাকায় রাতে দৈনিক দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ পেয়ে থাকে। বিদ্যুতের এই ভেলকিবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীসহ জনসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের মনপুরায় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করার জন্য দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সব শ্রেণির পেশার মানুষ।
২৪ ঘণ্টায় জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন নাগরিক কমিটিসহ সর্বস্তরের মানুষ। জনসাধারণের একমাত্র দাবি জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ।
ভোলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একমাত্র উপজেলা মনপুরা যেখানকার অধিবাসীরা এখনও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২ ঘণ্টা বিদ্যুত রুটিন মাফিক পায়। মুজিব বর্ষে ন্যায্যমূল্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। দ্রুত মনপুরায় জাতীয় গ্রিড বিদ্যুৎ দিয়ে আলোকিত করার দাবি জানিয়েছেন এখানকার সচেতন মহল।
খোঁজ নিয়ে ও স্থানীয় গ্রাহকরা জানায়, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড উপজেলা সদর ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন রাতের বেলায় দৈনিক ৬ ঘণ্টা বিদ্যুত দিয়ে আসছে। গত জুলাইয়ের মধ্যভাগে ১ হাজার কেভিএ (১ মেগাওয়াট) উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন মেশিনটি ভাষ্ট হয়ে সম্পূর্ণ বিকল (নষ্ট) হয়ে যায়। যার ফলে গ্রাহকের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বিদ্যুৎ বিভাগ। বিকল্প হিসেবে ৬৫০ কেভিএ, ৫০০ কেভিএ ও ৫০০ কেভিএ তিনটি পুরাতন মেশিন চালু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেও তা গ্রাহকের চাহিদা মোটেও পূরণ করতে পারছে না। ৬ ঘণ্টার বিপরীতে মাত্র পারটাইম এলাকা ভিত্তিক দুই ঘণ্টা বিদ্যুত সরবরাহ করে বিদ্যুত বিভাগ। তিনটি পুরাতন মেশিনের মধ্যে দুটি মেশিন আবার নষ্ট হয়ে যায় অতিরিক্ত লোডের কারনে। একটি মেশিন চালু করে কোনোমতে উপজেলার প্রধান বাজার হাজিরহাট বাজার ভাগ ভাগ করে দৈনিক দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ দিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুত বিভাগ। যার ফলে এলাকা এখন পুরো অন্ধকার। কখনও কখনও কোনো এলাকা দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ পায় অন্য এলাকাগুলো অন্ধকারে থাকে। বিদ্যুতের এমন ভেলকিবাজিতে অতিষ্ঠ ব্যবসায়ীসহ জনসাধারণ।
বিদ্যুত না থাকার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের দোকানের ফ্রিজ, টিভিসহ লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেশির ভাগ ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। বিদ্যুৎ না থাকায় তারা রাতে পড়ালেখা করতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সরকারি কার্যক্রম চালাতেও বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের।
উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে সোলার মিনি গ্রিডের বিদ্যুৎ রয়েছে। সোলার মিনি গ্রিডের উৎপাদিত বিদ্যুত তাও গ্রাহকরা ঠিকমতো পাচ্ছে না। সবার একটাই দাবি জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মনপুরা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসনিয়া নিশাত কপি (বাতির) আলোতে খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করছে।
হাজির হাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র মো. সাঈদ আবদুল্লাহ নিহাল হারিকেনের আলোতে পড়ালেখা করতে দেখা গেছে। এই চিত্র এখন উপজেলার প্রায় সব বাড়িতে। ব্যবসায়ীরা সোলার বাতির আলোতে বেচাকেনা করতে দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় সবাই কষ্ট করে দিন পার করছেন।
বিদ্যুৎ গ্রাহক কামরুল ইসলাম, মো. বেলাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ পাই না । অথচ প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। কবে বিদ্যুৎ পাবো তাও জানি না।’
হাজিরহাট বাজার ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা মাত্র রাতের ১০টার সময় দুই ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ পাই। বিদ্যুতের অভাবে আমাদের দোকানের ফ্রিজ নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারের সকল ব্যবসায়ীদের একই অবস্থা। কবে বিদ্যুত পাবো তা বলতে পারেনা বিদ্যুত অফিস।’
হাজির হাট মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বিদ্যুতের অভাবে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যুতের কারণে ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারছে না। আমরা তাড়াতাড়ি বিদ্যুতের এই অবস্থার পরিবর্তন চাই। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ চাই।’
আবাসিক প্রকৌশলী আব্দুস ছালাম বলেন, ‘আমাদের তিনটি মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। একটি মেশিন দিয়ে আমরা পার্টটাইম এলাকাভিত্তিক বিদ্যুত দিয়ে যাচ্ছি। আমরা মেশিন মেরামতের কাজ করছি। মেশিন ঠিক হলে আমরা আবার আগের মতো বিদ্যুৎ দিতে পারবো। গ্রাহকদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমাদের আন্তরীকতার কোনো ঘাটতি নেই। এ বিষয়ে আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানেন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি উপজেলার উন্নয়ন অনেকাংশে বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে। বিদ্যুৎ না থাকলে উন্নয়ন চোখে পড়ে না। সত্যি কথা বিদ্যুত না থাকায় আমাদের অফিসের কার্যক্রম চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে। আমি বিদ্যুতের বিষয় জেলা প্রশাসক মহোদয়সহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানের বিষয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এমপি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করছি, দ্রুত বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান হবে।’