বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মহালয়ার তাৎপর্য ও গুরুত্ব

আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:২৪

‌‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে, বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর; ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা; প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।’

রেডিওর উপরে জমে থাকা সারা বছরের পুরু ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে মহালয়ার ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচিত সুর শোনার জন্য প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। এই সুর মিশে গেছে সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রক্তে রক্তে। শারদ প্রাতে আলোকবেণু বাজতে আর কয়েকদিন বাকি আছে। চারিদিকে পুজো পুজো রব। মহালয়ার দিন পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে, মাতৃপক্ষ শুরু হয়। সেদিনই আক্ষরিক অর্থে দুর্গাপূজার সূচনা।

মহালয়া শব্দটির অর্থ, মহান আলয় বা আশ্রম। এক্ষেত্রে দেবী দুর্গাই হলেন, সেই মহান আলয়। পুরাণ থেকে মহাভারত, মহালয়া ঘিরে বর্ণিত আছে নানা কাহিনী। মহালয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ রীতি। এই বিশেষ দিনই দেবীর দুর্গার চক্ষুদান হয়। রামায়ণ অনুসারে, রাবণ বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা শুরু করেন, যা বর্তমানে বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। শ্রীরামচন্দ্র পরবর্তীকালে শরৎকালে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন, যা অকালবোধন নামে পরিচিত। এরপর থেকেই শারদীয়া দুর্গাপূজা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। 

পুরাণে বলা আছে মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করার দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত কোনো মানুষ বা দেবতার পক্ষে মহিষাসুরকে বধ করা সম্ভব ছিল না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর তার ক্ষমতার দম্ভে মদমত্ত হয়ে ওঠে। একে একে দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী তখন বাধ্য হয়ে মিলিতভাবে মহামায়ার রূপে অমোঘ নারী শক্তি সৃষ্টি করলেন। দেবতাদের দান করা ১০টি অস্ত্রে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা সুসজ্জিত হয়ে উঠেন। ৯ দিন ব্যাপী ঘোরতর যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন। মহালয়া হচ্ছে সেই দিন যেদিন দেবী দুর্গা এই মর্ত্যে অবতরণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনার দিনটিকেই মহালয়া হিসেবে উদযাপন করা হয়। দুর্গা পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বড় উৎসব। মহালয়ার দিন থেকেই পূজার ভাব চলে আসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে। হিন্দুশাস্ত্র মতে, মহালয়ার দিনই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়েছিলেন দেবী দুর্গা। এই বিশেষ দিনে মহিষাসুরকে বধ করে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে এবং শুভ শক্তির আরাধনায় তাই মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

মূলত দুর্গা পূজার সূচনা মহালয়া দিয়ে হলেও মহালয়ার সঙ্গে কিন্তু দেবী পূজার কোনো মিলই নেই। তবে মহালয়া মানে তিন পুরুষের আত্মা শান্তির জন্য একটা বিশেষ দিন। এদিন ভোরে তর্পণ করা হয়। গঙ্গায় গিয়ে তিন পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় জল ও তিল দিতে হয়। আর মহালয়া থেকে শুরু হয় প্রতিপদ, প্রথমা দ্বিতীয়া, তৃতীয়া এসব। আর তারপরই দেবীর অকাল বোধন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যরে মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক হলেন মৃত্যু দেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। মহালয়া যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা এক অমোঘ বিশ্বাস, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের ধারণাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। অশুভ শক্তির বিনাশ, মন্দের ওপর ভালোর জয়কে তুলে ধরার জন্য মহালয়া।

ইত্তেফাক/জেজি/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন