বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

পারুদার মুখে শোনা গল্প

আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:৫১

অনেকদিন পর পারুদার সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমায় বসালেন। পাশের বেঞ্চিতে বসে রহিমের দোকানের ঈষদুষ্ণ গরম পানিতে হালকা লেবু দিয়ে চিনি ছাড়া চা দিতে বললেন। চিনি ছাড়া চা খেয়ে তিনি কীইবা উন্নতি করেছেন এ প্রশ্ন আমাদের বন্ধু মহলের।

আমরা জানি পারুদার ডায়াবেটিসের মাত্রা ১২ থেকে ১৪-এর ঘরে থাকে। আজীবন সাবধানে চলার পরও তার ডায়াবেটিস কমে না। তাহলে চিনি না খেয়ে কী লাভ?

এমন কথা রহিম নিজেও বলে। আমরাও বলি, এভাবে যদি সবাই চিনি খাওয়া ছেড়ে দেয় তাহলে চিনির ব্যবসা কীভাবে হবে। যারা চিনি বিক্রি করে তাদের সংসার চলবে কীভাবে। কাজেই জনগণের এই চিন্তায় আমরা সবাই চায়ে এক চামচ করে চিনি বেশি খাই। কিন্তু পারুদা ঠিক তার উলটো। তিনি সারাক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তিনি চিনি খাবেন না। শরীর ভালো রাখবেন।

আমরা সবাই একমত হলাম, পারুদা যতই বলুক আমরা চিনি খাওয়া ছাড়ব না। পারুদা বলতেন, একদিন তোমরা নিজেরাই ছাড়বে। তখন হয়তো আমার কথা মনে করবে। আজ দেখা হওয়ামাত্রই পারুদার সেই কথা মনে হলো। চিনি না খাওয়ার কথা।

পারুদা এখনো জানেন না, আমাদের বন্ধুমহলের সবাই চিনি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। না ডায়াবেটিসের কারণে নয়, আমাদের সংগতির অভাবে। সেদিন তো পান্থ কানাই বলল, না জানি কয়দিন পর চাল কেনা বন্ধ করে দিতে হবে।

—কেন?

—সংসার আর চলে না, সহজ উত্তর।

আজ পারুদাকে দেখামাত্রই পান্থ কানাইর কথাটি মনে হয়ে গেল। কত তাড়াতাড়ি সে কথাটি পারুদাকে জানাব, না কি নিজেরাই লজ্জা পাব, ভাবতেছি। আমাকে চুপ দেখে নিজেই বললেন, ভাবাভাবির কোনো কাম নাই। আমি জানতাম এই হাল হবে তোমাদের।

—কী হাল?

—মনে করছ আমি কিছুই জানি না। আরে সুবোধ বালক, যে কথা পাঁচ বছর আগে বলেছি, সেটাই তো হচ্ছে।

এটা জানি, পারুদার সঙ্গে কথা বলে পারব না। তাই অবনত মস্তকে বসে থাকি। চিনি ছাড়া রং চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে এক দুই চুমক দিতে থাকি। পারুদা এবার শুরু করে, বলে—বেণু অনেকদিন তোমাদের গল্প শোনাই না। একটি গল্প শুনবে?

পারুদার গল্প আর কী! সারাক্ষণ জীবনের কথা, সিরিয়াস কথা এসব। জীবনটা যেন সবসময়ই সিরিয়াস। রসিকতার মানে কী—পারুদা বোঝেন না। নাকি তার রসিকতাই তিনি করে থাকেন, কিন্তু আমরা বুঝি না কোনটা রসিকতা কোনটা সিরিয়াস কথা। পারুদা শুরু করলেন রূপকথার এক রাজ্যের গল্প। বললেন, একবার সেই রাজ্যে জিনিসপত্রের দাম খুব বেড়ে গেল। এই নিয়ে শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। রাজ্যের অধিকর্তা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। হুকুম করলেন দ্রুত আমদানি করতে। কিন্তু কীভাবে? রাজকোষে যে পর্যাপ্ত মুদ্রা নেই। এত এত স্বর্ণমুদ্রা গেল কই—রাজার বিস্ময়! ডাক পড়ল উজিরে আজমের। ভয়ে জুবুথুবু হয়ে হাজির হলেন রাজার সামনে।

—আমার কোনো দোষ নেই মহারাজ। রাজ্যে যে হারে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাতে এত এত প্রজাদের চাহিদা মেটাতেই কোষাগার খালি হয়ে যাচ্ছে।

—তাহলে এখন উপায় কী?

—মহারাজ, এমন কিছু করতে হবে যাতে প্রজাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়।

—যেমন?

—দুটো উপায় আছে মহারাজ। রাজ্যে এখন থেকে কেউ আর সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে—রাজ্যে জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। তাতে না খেয়ে মারা যাবে।

—থামুন। ধমকে উঠলেন মহারাজ। প্রজা না থাকলে আমি কীসের রাজা?

কথা শেষ হতে না হতেই রাজা মহাশয়ের কানে ভেসে এলো: মহারাজ আমি আসছি। রাজার সামনে এসে দাঁড়ায় বীরবল।

এবার পারুদা থামলেন। আবার শুরু করলেন। বললেন—এই রাজ্যেও বীরবল। সব রাজ্যেই কি একজন বীরবল থাকে? নাকি একই কাহিনির মতো করেই নানা দেশে নানা ভাবে একই বীরবল হাজির হয়, কে জানে?

বীরবল মহারাজের কানে কানে কী যেন বললেন। তারপর মহারাজ হুঙ্কার দিলেন—সবার ঘর তল্ল­াশি কর। যেখানে যা পাও ধরে আনো।

এ কেমন কথা! সভাসদের একজন উঠে দাঁড়ালেন।

বীরবলের উত্তর : এটাই কথা রাজাধিরাজ। আপনি শুরুতেই আপনার সভাসদ, তারপরে কামলাবৃন্দের ঘর তল্লাশি করুন।

—না তা কী করে হয়? অপরজন দাঁড়ালেন। এসময় আরো কয়েকজন সমস্বরে বললেন, তা হয় না মহারাজ।

বীরবল বলল, তাহলে থাক। তবে লোকের মুখে নানা কথা। তাই এখন একটু কঠিন হওয়া দরকার। লোকে বলে, কামলাদের কারো কারো ঘরে নাকি লক্ষ কোটি স্বর্ণমুদ্রা আছে।

এইবার রাজাধিরাজ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিলেন। এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেন। বিশেষ কায়দায় তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন কথার অনেক ক্ষেত্রেই সত্য।

তারপর রাজাধিরাজ বললেন, হে বীরবল তুমি কী করে এমনটি জানলে?

—আমি তো কিছুই জানতাম না মহারাজ। আমি শুধু অনুমান করে দেখেছি আমাদের কামলাদের কতজনের ছেলেমেয়ে ভিন্নরাজ্যে পড়াশোনা করে। একদিন কৌতূহলবশত এক কামলার খবর পেলাম তিনি নাকি এক নাজিরের কাছে, আরেকজন আত্মীয়ের বাসায় স্বর্ণমুদ্রা রেখে এসেছেন।

পারুদা আবার থামলেন। শেষে বললেন— এরকম ঘটনা নজিরবিহীন ছিল ঐ রূপকথার রাজ্যে।

ইত্তেফাক/জেডএইচ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন