‘নভেম্বর থেকে প্রতিদিন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগ ও আউটডোরে গরম পানিতে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোনো কোনো দিন ১৫ জনের অধিক শিশু পোড়া রোগী আসে শুধু গোসলের গরম পানিতে পোড়া—অথচ গরম পানি পাতিলে না নিয়ে, বালতি করে নিলে এই পোড়া রোধ করা সম্ভব’ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে মোট রোগীর ৫০ শতাংশ শিশু। কিছু বোঝার আগেই পোড়ার জন্য অনেকের অঙ্গহানি ঘটে। চিকিত্সকরা বলেন, কৃত্রিমভাবে যতই অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হোক না কেন, তা আর আগের মতো হয় না, ব্যয়বহুল হওয়ায় কৃত্রিম প্রতিস্থাপন সবার পক্ষে সম্ভবও হয় না। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, বাবা-মার সচেতনতাই পারে তা রোধ করতে। এজন্য প্রচারণার ওপর গুরুত্ব দেন তারা।
শিশু ওয়ার্ডের চিত্র: শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৬ মাস বয়সি সন্তান তাউসিমকে নিয়ে এসেছেন ময়মনসিংহের নাজমুন নাহার রুনি। তার বাঁ হাত সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। বাঁ পায়ে অল্প পোড়া আছে, একই পাশে হাতের নিচে, পেটে বিচ্ছিন্নভাবে পোড়া ক্ষত। তাউসিম একটু পর পর নিজের হাত দেখছে আর কাঁদছে। ছোট্ট তাউসিম বুঝতেই পারছে না তার কী হয়েছে, কিন্তু পোড়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে অবিরত। মা চুলা পরিষ্কার করে ছাই ফেলেছেন ঘরের পাশে, আর ছেলে গিয়ে পড়েছে সেই গরম ছাইয়ে।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে ২১ দিন আগে আড়াই বছরের ছেলে জুনায়েদকে নিয়ে এসেছেন মা ইয়াসমিন ও বাবা মাসুম সাজী। ভাতের মার গালার সময় ভাতের পাতিল ধরে টান দিয়ে শরীরের ১৩ শতাংশই পুড়িয়ে ফেলেছে জুনায়েদ। এখন শুধু যন্ত্রণায় কাতরায় সে। মা ইয়াসমিন জানান, ‘ড্রেসিং’ করানোর সময় প্রচণ্ড চিত্কার করে সে।
ডা. হামিদুর রহমান সবুজ জনান, এখানের বেশির ভাগ শিশুর অভিভাবক দরিদ্র, প্রতিদিন শিশুদের বেসিক কিছু পরীক্ষা করাতে হয়, তাও করাতে পারেন না। তাদের প্লাস্টিক সার্জারির খরচ সমাজসেবা অধিদপ্তর অনেকটা বহন করে। কিন্তু একজনের জন্য ২০ হাজারের বেশি টাকা দেওয়া হয় না। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেল, ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা কিছু বোঝার আগেই বাবা-মায়ের অসচেতনতায় পুড়ে ছটফট করছে।
পোড়া পরবর্তী জটিলতায় শিশুরা: ১ হাজার ১ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের কতর্ব্যরত চিকিত্সক লুত্ফুননাহার নিবীর জানান, এই তলায় পোড়া এবং পোড়া পরবর্তী জটিলতার চিকিত্সা নিতে আসা ৭০ জন রোগী আছে। তাউসিম চার মাস আগে চিকিত্সা নিয়ে বাড়ি ফেরে চলে যায়। বাড়িতে গিয়ে করার জন্য কিছু ব্যায়াম ও সতর্কতার বিষয় জানানো হয়। কিন্তু তা না করানোর ফলে তার হাতটি শরীরের সঙ্গে লেগে যায়। এই অবস্থায় আবার চিকিত্সার জন্য এলে অপারেশনের মাধ্যমে হাতটি শরীর থেকে আলাদা করা হয়। লুত্ফুননাহার বলেন, অনেক পরিবার সচেতন নয় বলে আমাদের নির্দশাবলী বা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে না। ফলে পোড়া পরবর্তী জটিলতা নিয়ে অনেকে আসেন। প্রত্যেক বারই তাদের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যয়বহুল চিকিত্সা নিতে হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, ২০২১ সালে মোট ৩ হাজার ৪৮৫ জন, ২০২২ সালে ৩ হাজার ২৭৫ জন এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর ২৫ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭০৭ জন পোড়া রোগী চিকিত্সা নিতে আসেন। যার মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশ শিশু।
কীভাবে পুড়ছে শিশুরা: বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন ইত্তেফাককে বলেন, বাবা-মা অসচেতনতায় ৯০ শতাংশ শিশু পোড়ার ঘটনা ঘটে। গরম পানি, গরম ডাল, গরম দুধ পড়ে শিশুরা পুড়ছে। শীত আসছে, এসময় গোসলের গরম পানিতে শিশুদের একটা বড় অংশ পোড়ে। এছাড়া শীতে আগুন পোহাতে গিয়ে, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ধরা-ছেঁড়া, ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শক লাগা, চুলায় পড়া, দাহ্য পদার্থ শিশুদের হাতের নাগালে রাখা— এমন সব অসচেতনতায় শিশুরা পুড়ে যায়।
কী করতে হবে/কী করতে হবে না: পিতা-মাতার সচেতনতা বাড়লে কমতে পারে শিশু পোড়ার ঘটনা। এজন্য গণমাধ্যম ও পাঠ্য পুস্তকে প্রচারণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। শিক্ষা বোর্ডের এ সম্পর্কিত একটি তহবিল থাকলেও তা ব্যবহার হয় না বলে জানান তিনি। প্রতিষ্ঠানের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হেদায়েত আলী খান ইত্তেফাককে বলেন, ১০ শতাংশ পর্যন্ত শিশুর পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে ঝুঁকি কম থাকে। এর চেয়ে বেশি হলেই ঝুঁকি বাড়তে থাকে। রোগীরা পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিত্সার জন্য আসে না। ডিম, লবণ, পেস্ট ক্ষত স্থানে দিয়ে জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পোড়া স্থানে ৩০ মিনিট স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে চিকিত্সকের কাছে আনতে হবে।
জানা যায়, গুরুতর চিকিত্সার জন্য এই হাসপাতালে আইসিইউ এবং হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট-এইচডিইউ আছে। এখানে ১৫টি শয্যা শিশুদের জন্য। তবে রোগীর তুলনায় তা অপ্রতুল।