পুরান ঢাকার বাংলাবাজার পেরিয়ে প্যারিদাস রোড। এই রোডের শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং। একসময় বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল এটি। যেন এক জীবন্ত ইতিহাস সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চল্লিশের দশক থেকেই সুখ্যাতি লাভ করেছিল বোর্ডিংটি। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকতার উত্থানে এটা অনেক পিছিয়ে পড়ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে নানামুখী সংকট। এখন শুধু ঐতিহ্য ধরে রাখতেই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিউটি বোর্ডিং রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি খুব ভালোভাবেই চলছিল। প্রতিনিয়ত ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে। বর্তমানে ব্যাপক আর্থিক সংকট। সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করতে পারায় তরুণ প্রজন্মেরও নেই আগ্রহ।
বিউটি বোর্ডিংয়ের ইতিহাস
বিউটি বোর্ডিংয়ে প্রথমে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগে মানুষ এটিকে জমিদার বাড়ি বলেই চিনতো। কেননা বাড়িটি ছিল জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। তিনি ভারত চলে গেলে বাড়িটিতে গড়ে ওঠে একটি ছাপাখানা। আর এখান থেকেই প্রকাশিত হতো সোনার বাংলা পত্রিকাটি। দেশ ভাগের পর পত্রিকা অফিসটি স্থানান্তরিত হয়ে কলকাতায় চলে গেলে ১৯৪৯ সালে নলিনী মোহন সাহা ও প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা (দুই ভাই) মিলে ১১ কাঠা জমির বাড়িটি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। এটির নামকরণ করা হয় নলিনী মহনের বড় মেয়ে বিউটির নামে। বিউটি বোর্ডিং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মুখরিত হয়ে থাকতো প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের আনাগোনায়।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারান প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রকাশক হেমন্ত কুমার সাহা, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অহিন্দ চৌধুরী শংকর, চিত্রশিল্পী হারাধন বর্মণ, অভিনেতা যোশেফ কোরোয়া, সমাজসেবক নির্মল রায় খোকাবাবু, শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র সাহার মতো ব্যক্তিরা। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চের ওই হামলার পর প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারতে চলে যায়। পরে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা তার দুই ছেলে সমর সাহা এবং তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন।
শিল্প-সাহিত্যের ঐতিহাসিক আঁতুড়ঘর
বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির রেনেসাঁ ঘটে বিউটি বোর্ডিং ঘিরে আড্ডার আসরে। মূলত দেশ ভাগের পর বাংলাবাজার এলাকাটি হয়ে ওঠে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্রস্থল। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা লেখক ও প্রকাশকের আনাগোনায় মুখরিত ছিল এলাকাটি। তাই শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিমনষ্ক লোকজন একটু স্বস্তি নিতে এবং সমমনা ব্যক্তিরা তাদের মতবিনিময় করতে আশ্রয় নিতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। তখন থেকে এটি পরিণত হয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্রে। আর এখন ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। এই বিউটি বোর্ডিংয়ে চলতো নিয়মিত জমজমাট আড্ডা আর, তা থেকে তৈরি হতো কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড। এখানকার আড্ডাবাজদের 'বিউটিয়ান' নামে আখ্যায়িত করা হতো।
কবি শামসুর রাহমান, আলাউদ্দীন আল আজাদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নিতুন কুণ্ড, সমুদ্র গুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, কবি ইমরুল চৌধুরী, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, জিয়া আনসারী, দেবদাস চক্রবর্তী, ফয়েজ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি আল মাহমুদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, শফিক রেহমান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আনিসুজ্জামান, মহাদেব সাহা, সমর দাশ, সত্য সাহা, জহির রায়হান, খান আতা, গোলাম মুস্তাফাসহ বহু বিখ্যাত শিল্প-সাহিত্যিক আড্ডা দিতেন বিউটি বোর্ডিংয়ে। ফজলে লোহানী, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচেরও আনাগোনা ছিল এখানে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আড্ডায় দেখা যেত অলি আহাদ, সাইফুদ্দিন মানিক, কমরেড আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখ। এই বিউটি বোর্ডিংয়ে জন্ম হয়েছিল বহু তরুণ সাহিত্যিকের। কবি শামসুর রাহমান প্রথম কবিতা লিখেছিলেন এই বিউটি বোর্ডিংয়ে। এখানে বসেই সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন অনেক সাহিত্যকর্ম। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অনুপম দিন, এক মহিলার ছবি, কয়েকটি মানুষের সোনালি ছবি, সীমানা ছাড়িয়ে এবং জনক ও কালো কফিন।
কিংবদন্তি আবদুল জব্বার এখানে বসেই লিখেছিলেন প্রথম সবাক ছবি মুখ ও মুখোশের চিত্রনাট্য। এখানে কাচের দেয়ালসহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি রচিত হয়েছে। এছাড়া প্রখ্যাত সুরকার সমর দাসের হাতে বাংলার কালজয়ী সব গানের সুর সৃষ্টি হয়েছে এই বিউটি বোর্ডিংয়েই। এখানকার নিয়মিত আড্ডায় অংশ নিতে এসে বহু সাহিত্যিক, প্রকাশক ও সাংবাদিক মিলিত হয়ে প্রকাশ করেছেন কয়েকটি সাময়িক পত্রিকা। এই কারণে স্মৃতিধন্য বিউটি বোর্ডিং।
এছাড়া ঐতিহাসিক স্থানটিতে স্বাধীনতার আগে এসেছিলেন নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু। আরো এসেছেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। এছাড়া এখানে বহু সভা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং স্বাধীনতার নানা দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। কিংবদন্তিদের পদচিহ্নের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বিউটি বোর্ডিং।
দর্শনার্থীদের চোখে বিউটি বোর্ডিং
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান বলেন, বিউটি বোর্ডিং নামটা শুনে যেমন পুরোনো এক সজীবতার ছায়া চোখে ভাসে, এই কলের কালো ধোঁয়ার যুগে এসেও এখানে রয়েছে ৯০ দশকের পরিবেশ, রয়েছে নানান সাহিত্যিক গুণীজনের পদচারণা, যা আমাদের এখানে আসতে আকৃষ্ট করে। খুঁজতে আসি কি ছিলো এই জায়গায় যা বাংলার এতো লেখক-সাহিত্যিককে এখানে আসতে বাধ্য করতো। পাশাপাশি এখানকার বাঙালিয়ানা খাবারের সাধ নিতেও অনেকে আসি।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আফনান আহমেদ রাশেদ বলেন, পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিং আমার বরাবরই পছন্দ। এখানে যতবার এসেছি স্নিগ্ধ, সুন্দর, ভাবনার মহিমায় হারিয়ে যাওয়া যাই। বিশেষ করে এখানকার চা আমার খুবই পছন্দের। ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে জেনেছি, এখানে দেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিকসহ সৃজনশীল ব্যক্তি এসে সময় কাটাতেন। তাই যতবার আসি, নিজেকে ইতিহাসের অংশ মনে হয়।
তিনি বলেন, যেহেতু ঢাকার ঐতিহ্য বহন করে বিউটি বোর্ডিং, তাই এই দর্শনীয় জায়গা হিসেবে সরকার চাইলেই আরো জনপ্রিয় করে তুলতে পারে এবং ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারের আরো এগিয়ে আসা উচিত। একজন ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি হিসেবে বরাবরই চাইবো, বিউটি বোর্ডিং আরো জনপ্রিয়তা লাভ করুক।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাঈম রাজ বলেন, ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং তার পুরোনা ঐতিহ্য হারালেও এখনো অনেক চলচ্চিত্রকার, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, অভিনেতা সময় পেলেই এখানে চলে আসেন। আমিও প্রায়ই এখানে আসি। এটিই আমাদের দেশের সংস্কৃতির আতুড়ঘর। এখানে এসেছেন অংসখ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এই সাংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রকে আমাদের যত্নে রাখা উচিৎ। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে নানামুখী সংকট লক্ষ্য করা যায়। এটার ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসা উচিত।
এখনো আছে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
দোতালা ভবনের নিচতলায় রয়েছে খাবার ব্যবস্থা। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য তিনবেলা খাবার ব্যবস্থাই থাকে। খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত, ডাল, সবজি, শাক ভাজি, ভর্তা, বড়া, চড়চড়ি, সরিষা ইলিশ, রুই, কাতলা, বাইলা, তেলাপিয়া, চিতল, পাবদা, ফলি, সরপুটি, শিং, কৈ, মাগুর, ভাংনা, চিংড়ি, চান্দা, বোয়াল, কোরাল মাছ, আইড় মাছসহ বিভিন্ন সুস্বাদু মাছ। এছাড়া বিউটি বোর্ডিংয়ে চাইলে থাকা যাবে। এখানে সব মিলিয়ে ২৭টি থাকার ঘর আছে। এর মধ্যে ১৭টি সিঙ্গেল বেড ও ১০টি ডাবল বেড।
এখন যেমন আছে
বিউটি বোর্ডিংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক বিজয় পোদ্দারের সঙ্গে। তিনি ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, আমি ১৯৭৫ সাল থেকে এখানে দায়িত্ব করে আসছি। বিউটি বোর্ডিংয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল রেস্টুরেন্ট ব্যবসার মাধ্যমে। পরে এখানে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সেই আড্ডাতেই মূলত এখানে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিরা শামিল হতেন।
বর্তমানে বিউটি বোর্ডিংয়ের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা তেমন ভালো না। প্রতিদিনই ব্যবসা খারাপ হচ্ছে। এটি চালাতে আমরা এখন হিমশিম খাচ্ছি। এটার কারণ হচ্ছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি। ব্যবসায়িক লোকজন অর্থাৎ যারা এখানে এসে থাকতেন- তারা এখন ঘরে বসেই তাদের জিনিসপত্র পেয়ে যাচ্ছেন। তাদের ঢাকায় কষ্ট করে আসতে হয় না। তাছাড়া যানজটে কারণেও মানুষের ঢাকা যাত্রা অনেকটা কম। আগে তো এতকিছু ছিল না। মানুষ আসতো এখানে থাকতো। তখন ভালোই চলতো। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা বিউটি বোর্ডিং এতটা আধুনিক করতে পারিনি। কাস্টমারদের সুযোগ-সুবিধা কিছু বৃদ্ধি করা, সেই অবস্থাটাও আমাদের নেই। আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আশেপাশে খাবার হোটেলের সংখ্যা বেড়েছে। এখন আধুনিক ছেলে-মেয়েরা মাংসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। আমাদের এখানে মূলত একেবারে বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যেমন- ভাত, মাছ, ডাল, ভর্তা ও সবজি। এটার উপরে মানুষের চাহিদা কম। যার প্রেক্ষিতে নতুন প্রজন্মের কাছে এটার গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিউটি বোর্ডিংয়ের কালো অধ্যায় নিয়ে তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিউটি বোর্ডিংয়ের মালিকসহ ১৭ জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। অনেক চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা ‘শহীদ পরিবার’ হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। সেই জায়গা থেকে আমরা সরকারের ব্যাপারে নিরাশ। তবে বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহ্য অম্লান রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। জানি না আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী করবে।