মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৩৮২ কোটি টাকা নয়ছয়

আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:১৩

ঢাকার নামি প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কয়েক শ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) এক তদন্ত রিপোর্টে। ডিআইএ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সরকারি দপ্তর, যেটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিদর্শন ও তদন্ত করে থাকে।

ডিআইএ সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি তদন্ত করে ১৭৯ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। রিপোর্ট দেখে সবাই হতবাক। এ কারণে যে, এই প্রতিষ্ঠানে গত ছয় বছর ধরে গভর্নিং বডির সভাপতি একজন আমলা। তিনি বর্তমানে একটি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ সচিব।

ফলে প্রশ্ন উঠেছে, সচিব সভাপতির সময়ে এত অনিয়ম ও দুর্নীতি কেন ও কীভাবে হলো? তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই গভর্নিং বডি শিক্ষার মানোন্নয়নে কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা পরিলক্ষিত হয়নি।

তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানে ২০১৮-১৯ সালে বিধিবহির্ভূতভাবে ৮৯ জন শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিপত্রের নিয়ম মানা হয়নি।

দীর্ঘদিন ধরেই এই অনিয়ম চলতে থাকায় সভাপতিকে সরিয়ে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল অভিভাবক ফোরাম। কিন্তু ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এই সভাপতিকে সরাতে সমর্থ হয়নি বলে অভিভাবকেরা অভিযোগ করেন।

তদন্ত রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা হলেও শিক্ষাসচিব সোলেমান খান বলেছেন, মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট এখনো জমা হয়নি। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা ঠিক হবে না।  সরকারের একজন ‘সচিব’ সভাপতি থাকার পরও কীভাবে এই অনিয়ম হলো—এ বিষয়ে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, রিপোর্ট পেয়েছি। সেগুলোতে এখন ব্রডশিট জবাবের কাজ চলছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগবে। এর বাইরে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।

রিপোর্টের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা অবগত হলেও তারা বিব্রত বোধ করছেন। কীভাবে একজন পূর্ণ সচিবকে ডেকে জবাব চাইবেন, তা নিয়েও বিব্রত বোধ করছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সরকারি বিধি না মেনে শুধু পরিচালনা কমিটির ইচ্ছায়ও শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে।

গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি হিসেবে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট থেকে ছয় মাস ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল উদ্দিন, ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় মাস ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন যুগ্ম-সচিব আমিনুল ইসলাম খান। এরপর ২০১৭ সালের ৪ মে থেকে টানা ছয় বছর ধরে গভর্নিং বডির সভাপতি রয়েছেন আবু হেনা মোরশেদ জামান। বর্তমানে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব। সব মিলে সাত বছর কমিটিতে ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

প্রতিবেদন মতে, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাধারণ তহবিলের ১৩ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার ৫০ টাকা আত্মসাত্ হয়েছে এবং ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকার হিসাবে গরমিল রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির তিনটি গাড়ি থাকলেও প্রতি শাখায় তিনটি গাড়ির তথ্য দিয়ে জ্বালানি খরচের বিল করা হয়েছে ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ টাকা। তিন গাড়ি মেরামতে ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮২ টাকা খরচেও বিধি মানা হয়নি। পরে দরপত্র ছাড়াই ১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কেনা হয়। জেনারেটরের জ্বালানি ও মেরামতে ২২ লাখ ৯৮ হাজার ৬২২ টাকা খরচেও বিধি মানা হয়নি।

ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদ্য পদত্যাগ করা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফওজীয়া রাশেদীসহ ১৭ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রাপ্য বেতন-ভাতার বাইরে মোট ২২ লাখ ২ হাজার ১৪০ টাকা অতিরিক্ত উত্তোলন করেছেন।

ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আর্থিক বিধিতে প্রভিশন না থাকা সত্ত্বেও স্কুলটির প্রতিটি শাখা থেকে গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা সম্মানী নিয়েছেন। গত ৯ বছরে গভর্নিং বডির ১৩ জন সদস্য সম্মানী নিয়েছেন ৩৩ লাখ ২৩ হাজার ৩৮৬ টাকা, তাদের আপ্যায়নে খরচ হয়েছে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ২৮৬ টাকা এবং জিবির পেছনে আনুষঙ্গিক ব্যয় হয়েছে ৩১ লাখ ৬৭ হাজার ৯৭৬ টাকা। আর এই গভর্নিং বডি নির্বাচনের পেছনে ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫২ টাকা। সব মিলিয়ে এই অঙ্ক ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার মতো। টিউশন ফির টাকায় গভর্নিং বডির সদস্যরা ব্লেজারও কিনেছেন। তারা প্রতিটি ব্লেজার কিনেছেন ৪১ হাজার টাকায়। এর জন্য ১৩ জন সদস্য নিয়েছেন ৫ লাখ ৩৬ হাজার ৮২ টাকা।

ঐ তদন্তে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত ১১ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সব মিলিয়ে ৩৮২ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম পাওয়া গেছে। করোনার সময় বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও অর্থ ব্যয়, গাড়ি ও জেনারেটরে অস্বাভাবিক জ্বালানি খরচ, বিধিবহির্ভূত নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, কেনাকাটা, পূর্ত কাজসহ বিভিন্ন খাতে এই অনিয়ম হয়েছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, কমিটির মেয়াদ শেষে হয়ে যাচ্ছে। ডিআইএর রিপোর্টের আলোকে মন্ত্রণালয় বোর্ডকে নির্দেশনা দিলে কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে চাইলে গভর্নিং বডির সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান ফোন রিসিভ করেননি। মোবাইল ফোনে এসএমএস দিলেও কোনো সাড়া দেননি।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন