বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়কে হাতি চলাচলের স্পটগুলোতে রাখা হয়নি কোনো ‘এলিফ্যান্ট পাস’। চলাচলের পথ বন্ধ হওয়ায় মূলত খাদ্যের অভাবে কেইপিজেড সংলগ্ন লোকালয়ে হাতির হামলা ও আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা জরুরি ভিত্তিতে হাতির চলাচলের জন্য অ্যাপ্রোচ সড়কে ‘এলিফ্যান্ট পাস’ বা বিকল্প রাস্তা তৈরির দাবি জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় জানা যায়, দেয়াং পাহাড়ের কেইপিজেড এলাকা থেকে পানির ট্যাংক এবং মুহাম্মদপুর এলাকার আশপাশের জায়গা দিয়ে বটতলী, হাজিগাঁও এলাকার পাহাড় এবং ফসলি জমিতে বিচরণ করতো দেয়াঙ পাহাড়ে বসবাসরত হাতিগুলো। এখনো বিভিন্ন সময় হাতিগুলোকে টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়ক পার হয়ে এসব এলাকায় বিচরণ করতে দেখা যায়। তবে টানেল উদ্বোধনের পর যান চলাচল শুরু হওয়ায় এই এলাকা দিয়ে হাতির যাতায়াত অনেকটা কমেছে।
টানেলের আনোয়ারা প্রান্তের সাড়ে ৩ কিলোমিটার এপ্রোচ সড়কের দক্ষিণ বন্দর কান্তিরহাট, খোলালপাড়া, মুহাম্মদপুর এলাকায় মানুষ এবং যান চলাচলের জন্য তিনটি আন্ডারপাস করা হয়েছে। কিন্তু হাতিরাও এসব এলাকায় যাতায়াত করে। তাদের চলাচলের কয়েকটি স্পট সম্পর্কে স্থানীয়রা ভালোভাবে অবহিত। কিন্তু সেসব স্পটে হাতিদের চলাচলের জন্য রাখা হয়নি কোনো ‘এলিফ্যান্ট পাস’। স্থানীয়দের মতে, যাতায়াতের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি ও খাদ্যের অভাবে হাতিরা বিরক্ত হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে গত প্রায় পাঁচ বছরে কর্ণফুলী ও আনোয়ারায় অন্তত ১৭ জন হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৬০-৭০ জন। তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর করেছে হাতির পাল।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ জামাল উদ্দিন জানান, কর্ণফুলী উপজেলার শাহমীরপুর এলাকা থেকে আনোয়ারার বটতলী শাহ্ মোহসেন আউলিয়া (রহ.) এর মাজারের দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত দেয়াঙ পাহাড়। ব্রিটিশ আমলেও এই দেয়াঙ পাহাড়ে বাঘ, ভল্লুক, শৃগাল, নানান রকমের হরিণ এবং হাতির বসবাস ছিল। আনোয়ারায় ‘বাঘমারার চর’ নামের একটা জায়গা আছে এখনো। জানা যায়, ওখানে বাঘ মেরে নেওয়া হতো। কিছু বছর আগেও হরিণ দেখা যেত দেয়াঙ পাহাড়ে, যা মানুষের অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মাঝখানে পাহাড় নিধন ও বন ধ্বংস করার কারণে হাতিগুলো বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। পরবর্তী সময়ে কয়েক বছর আগ থেকে হাতিগুলো তাদের পুরোনো বাসস্থান দেয়াঙ পাহাড়ে আসা-যাওয়ার এক পর্যায়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। হাতিরা খাবারের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় বিচরণ করে। আমরা যদি হাতিগুলোকে বিরক্ত করি, চলাচলে বাধা সৃষ্টি করি, তাহলে তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া জানান, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা সাংবিধানিক আইন। সুতরাং বড় ধরনের প্রকল্প নেওয়ার আগে জীববৈচিত্র্যে কোনো ধরনের সমস্যা হবে কি-না, এই বিষয়ে স্টাডি করা উচিত। যদি সমস্যা হওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়, তাহলে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব না ফেলে এটা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। হাতির বিচরণের ক্ষেত্রে আন্ডারপাস, ওভারপাস যেগুলোকে এলিফ্যান্ট পাস বলা হয়, এগুলোর পরিকল্পনা করা হয়। হাতির চলাচল ও খাদ্য সংগ্রহে বিঘ্ন হলে তারা বিরক্ত হবে। তবে এখন অন্যত্র সরে যাওয়ার মতো জায়গা না থাকায় এগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হাতি এমন একটা প্রাণী, তারা যে জায়গায় বিচরণ করে সে জায়গায় ১২ বছর ধরে বিচরণ করতে থাকে। আনোয়ারা এলাকা একসময় হাতির অভয়ারণ্য ছিল। এখন এটি লোকালয়। স্বাভাবিকভাবে হাতিগুলোকে অন্যত্র সরানো সম্ভব নয়। বনাঞ্চল কিংবা হাতি চলাচলের পাশে রাস্তা করা হলে হাতির স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হবেই। হাতিগুলো হয়তো স্বাভাবিকভাবে অন্য আরেকটি চলাচলের রাস্তা করে নেবে। কোনো জায়গায় হাতি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হলে তাদের পথ পরিবর্তনের বিষয়ে কাজ করি আমরা।’