‘রাজনীতিতে কোনো বন্ধু নাই এবং কোনো শত্রুও নাই—ইহা সর্বদা স্থান ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।’ উক্ত বাক্যটি পাকিস্তানের রাজনীতির সহজ পাঠ। পারমাণবিক শক্তিধর দেশটির ইতিহাসে বেশির ভাগ সময় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেনা অথবা সেনা-সমর্থিত সরকার দেশ শাসন করিয়াছে। সেনাবাহিনী যখন যাহাকে ‘কাঠের পুতুল’ মনে করিয়াছে, তাহাকেই ক্ষমতার আসনে বসাইয়াছে; ক্ষমতায় আসিবার পর পাশ কাটাইয়া চলিবার আলামত পরিলক্ষিত হইলে ছুড়িয়া ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহার সর্বশেষ উদাহরণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং তাহার দল পিটিআই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়িয়া ক্রিকেট মাঠ হইতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন তিনি। ইহার পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে নানা ইস্যুতে বাহাসে জড়াইয়া পড়ার ফলে যাহা হইবার তাহাই হইয়াছে! নজিরবিহীন সকল মামলায় জড়াইয়া কারাগারে অন্তরিন থাকিয়াই ভোট করিতে হইতেছে বিকল্প পথে।
গভীর রাজনৈতিক বিভাজন, অর্থনৈতিক সংকট, নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশটিতে ১৬তম জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছে বৃহস্পতিবার। এই লেখা পর্যন্ত ফলাফল প্রকাশের কাজ চলিতেছিল। অর্থাত্, চূড়ান্ত ফলাফলে রাজসিংহাসনে কে বসিতেছেন, তাহা স্পষ্ট করিয়া জানা যায় নাই। অবশ্য ভোটের ফলাফল পূর্ব হইতেই নির্ধারণ করা হইয়া গিয়াছে বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে!
কে ক্ষমতায় আসিল, কে আসিল না—তাহা বড় কথা নয়। বরং নির্বাচন কতোটা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ হইয়াছে, তাহাই বিবেচ্য। প্রশ্ন হইল, পাকিস্তানে যেই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাকে কি ‘নির্বাচন’ বলা যায়? নির্বাচনের দিন দেশ জুড়িয়া মোবাইল ফোন সেবা ও ইন্টারনেট বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। ব্যাপক সহিংসতার পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটিয়াছে। দুর্বৃত্তের গুলিতে এবং বোমা হামলায় নিহত হইয়াছেন খোদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থী এবং ৯ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ও প্রার্থীদের বাড়িতে গ্র্রেনেড হামলা চালানো হইয়াছে। হামলা-মামলা তো আছেই। আরো গুরুতর বিষয়, নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা সীমাহীন কারচুপির অভিযোগ তুলিয়াছেন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) বিরুদ্ধে। তাহাদের অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নহে, তাহার অজস্র প্রমাণ রহিয়াছে। বিশেষত, ইমরান খানের দল পিটিআইকে কার্যত পঙ্গু করিয়া দেওয়া হয় নির্বাচনের পূর্বে। শেষ পর্যন্ত স্বতন্ত্র প্রার্থী হইয়া শাকসবজি প্রতীকে ভোট করিতে বাধ্য হইয়াছেন নেতারা।
এই নির্বাচনে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত তো করিতে পারেই নাই, তাহার উপর ফল ঘোষণার ক্ষেত্রে গড়িমসি করিয়া বিতর্ককে আরো উসকাইয়া দিয়াছে। দেশটিতে সচরাচর নির্বাচনের দিন স্থানীয় সময় মধ্যরাতের মধ্যে কোন দল আগাইয়া থাকে, তাহার একটি পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু এইবারের ভোট গ্র্রহণের ২২ ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর ২৬৫ আসনের মধ্যে মাত্র ১৩টি আসনের ফল পাওয়া যায়। এইরূপ প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলের নেতারা অভিযোগ তুলিয়াছেন, ইহার মধ্য দিয়া কারচুপির কৌশল অবলম্বন করা হইয়াছে। পিটিআইয়ের অভিযোগ, তাহাদের প্রার্থীদের জয়ী হইতে দেখিয়াই মূলত বিলম্ব করা হইয়াছে নির্বাচনের ফল ঘোষণায়। তাহাদের দাবি, অনেক জায়গায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনের যেই পর্দায় ফল প্রদর্শিত হইতেছিল, তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। এই সকল বিষয়ে সংক্ষুব্ধ পিটিআই হুংকার দিয়াছে, ‘ষড়যন্ত্র’ করিয়া জনগণের রায় বদলাইয়া ফেলিবার অপচেষ্টার পরিণাম ভালো হইবে না।
উন্নয়নশীল বিশ্বে আমরা যেই সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতে দেখি, তাহাকে ‘ভরদুপুরেও অন্ধকার’ বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। এই সকল নির্বাচন কতটা গ্রহণযোগ্য হয়, তাহাই প্রশ্ন। বরং এই সকল ভূখণ্ডে নির্বাচনের নামে যাহা হয়, তাহা মশকরা বই আর কিছুই নহে। দেশের মানুষকে যেন কাঁচকলা দেখানো হয়! নির্বাচনের পাতানো ফলাফল বুঝিবার পরও কেহ কেহ অবশ্য নির্বাচনি ধারা সমুন্নত রাখিবার স্বার্থে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তবে দিন শেষে তাহাদের এবং ভোটারদের সহিত করা হয় রসিকতা। এই ধরনের নির্বাচন যে জাতির নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহা বলাই বাহুল্য। এই বিবেচনায় পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ কোন পথে হাঁটিতেছে, তাহাই বড় কথা। একই সঙ্গে ইহাও কোটি টাকার প্রশ্ন, উন্নয়নশীল বিশ্বে নির্বাচনের নামে মশকরা, ঠাট্টার যেই খেলা চলে, তাহার শেষ কোথায়?