শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

বসন্তের অণুগল্প

আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:১০

মেট্রোরেলে প্রেম | এহছানুল মালিকী
নয়টায় ক্লাস। সাড়ে আটটায় ফার্মগেট থেকে মেট্রোতে উঠলাম পল্লবী স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ৫ মিনিট হাঁটলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়। শেওড়াপাড়া আসতেই পেছন থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এলো—এই যে ভাইয়া, একটা ছবি তুলে দেন না।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা হাতে নিতেই দেখি স্কুলের ড্রেসে দুই বান্ধবী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একের পর এক ছবি ক্লিক করছি তো করছি। কিন্তু একজন থেকে যেন চোখ সরছেই না। হঠাত্ ছোঁ মেরে মোবাইল মালিক মোবাইলটি কেড়ে নিয়ে তোলা ছবিগুলো একমনে দেখতে লাগল। মুহূর্তেই মোবাইল মালিকের চেহারাটা মলিন হয়ে গেল, আর আমার পছন্দের মেয়েটা মিটিমিটি হাসতে লাগল। মেয়েটি আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল। কিছু বোঝার আগেই মেয়েটা আমার দিকে তেড়ে এসে জিজ্ঞাসা করল—এগুলো কী ছবি তুললেন? সবই তো আমার বান্ধবীর ছবি। আমার ছবিগুলো এক পাশ করে কাটা কেন?

মেয়েটির রাগী চাহনি দেখে গলা শুকিয়ে এলো। নিচু স্বরে জবাব দিলাম—সরি।

আমার অবস্থা বুঝে পছন্দের মেয়েটি উঠে বান্ধবীর হাত ধরে বলল—চল চল। সরি বলেছে। এখনই তো নামতে হবে।

কথাগুলো বলছে আর আমার দিকে তাকিয়ে তখনো মিটিমিটি হাসছে। মেট্রোর দরজাটা খোলা পর্যন্ত শুনতে পেলাম—আয়শা জানিস না, দশ নম্বর যদি না এসে পৌঁছতাম তাহলে ওর খবরই ছিল। ওরে ছবি তোলা জন্মের মতো শিখিয়ে দিতাম।

বুঝে গেলাম। আমার পছন্দের মানুষটির নাম আয়েশা। বুকের ভিতর ঢেউ খেলাটা যেন কোনোভাবেই থামছে না। আহা কী সুন্দর চোখ, নাক, ঠোঁট—নিজেই নিজেকে বলতে লাগলাম। সারা দিন ক্লাস, ল্যাব শেষে বাসায়। তবুও কেন জানি চোখ থেকে আয়েশার ছবিটা সরাতেই পারছিলাম না। ইস, আরেকটিবার যদি তাকে দেখতে পারতাম! পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় উদ্দেশ্যে ফার্মগেটে। র্যাপিড পাস কার্ড থাকায় সুরসুর করে গেটে ঢুকতে যাব, এমন সময় পিছনে তাকাতেই দেখি লম্বা টিকিট কাটার লাইন। হঠাত্ ভিড়ের মধ্যে চোখ দুটো আয়েশার দিকে স্থির হলো। মেয়েটা লম্বা লাইনের সর্বশেষে দাঁড়িয়ে। সাহস করে তার পিছনে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখে আয়েশা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না, সে আমাকে চিনতে পেরেছে। দুজনেই যেন থরথর করে কাঁপছি। কী বলব—খুঁজে পাচ্ছি না। মুখ ফসকে বের হলো, আজ মনে হয় প্রথম ক্লাসটা ধরতে পারব না। আয়েশাও বলে উঠল—আমিও।

দুজন দুজনের মুখোমুখি তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। হঠাৎ মাইকে আওয়াজ এলো, আপনারা যারা উত্তরার যাত্রী তারা ২ নম্বর কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করুন। শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক দৌড়ে কাউন্টারের প্রথমে দাঁড়িয়ে গেলাম। মিনিটেই দেখলাম আমার পিছনে একশো মানুষের লাইন। আর আয়শা সবার শেষে। মন খারাপ মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু বলতে চেয়েও যেন বলতে পারছে না। পাস কার্ডটি নিয়ে আয়েশার কাছে এলাম। আমাকে দেখে মলিন মুখে বলল, আল্লাহ হাফেজ। আমার আরো সময় লাগবে।

কার্ডটি ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম, এটা আপনার জন্য। আমার কার্ড আছে।

আয়েশা লাজুক হাসিতে আমার হাত থেকে কার্ডটি নেওয়ার সময় তার একটু আঙুলের ছোঁয়া আমায় যেন সমস্ত শরীর দোলা দিয়ে গেল। মনে হলো বসন্ত ছুঁয়ে গেল আমাকে।

------

 

শেষ ফোন | এমরান কবির
রাত বারোটা পার হয়েছে। শুয়ে পড়েছি। তখন ফোনে ম্যাসেজ টোন। সে একটা টেক্সট করেছে, ‘আজ ফোন দেব। শেষ ফোন।’ এই প্রথম বুকের ভেতরে শূন্যতা বোধ করলাম। আজ ফোনে কথা হবে—কিন্তু শেষ ফোন! অথচ আমি শুরুটাই শুরু করতে চাইনি। সবাই জোর করল। আমার মা-বাবা-ভাইবোন। ওরও মা-বাবা-বোন। সবারই একই কথা—একবার ফোন দিলে কী হয়! কিন্তু! কোথায় যেন বাধা।

একদিন মন খারাপের শুক্রবারে কী মনে করে তাকে ফোন দিলাম। সে চমকাল। কেন চমকাল—তা জানা হয়নি কোনোদিন। সেদিন দু-এক মিনিটের ফোনকলের অধিকাংশ সময় দুজনে নিশ্চুপ থেকেও বুঝতে পেরেছিলাম—সে জানত আমি ফোন করব কোনো একদিন। কিন্তু কীভাবে সে জানত, তা জানত না।

এভাবে চলল মাসখানেক। তারপর উভয় পরিবারের সম্মতিতে দেখা হলো একদিন। ক্ষণিক। কিন্তু ওটুকুতেই হূদয় বলে উঠল, আমি দেখলাম, আমি তাহাকে দেখলাম। যেন স্বাতী, নীল স্বাতী। সন্ত্রস্ত হৃদয় তার। নির্মিলিত চোখ, চাপা হাসি আর মধুর অস্বস্তি। আমি হয়তোবা তাকাতে চাইনি। কিন্তু চোখ চলে যায়। আর কী আশ্চর্য সমস্ত সংকোচ ভেদ করে কীভাবে যেন তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে যায়।

তারপর ফিরে আসি। আগে যেখানে ফোনের অধিকাংশ সময় নীরবে কেটে যেত, সেখানে এখন টুপটাপ ঝরে পড়ে কত কথা। কখন যে স্বচ্ছ ঝরনার জলে ভেসে গেছে সংকোচের অর্গল, কখন যে পাহাড় থেকে ধসে পড়েছে সকল অস্বস্তি, কখন যে নদীর স্রোতে ভেসে গেছে জড়তার বাঁধ—কেউ জানি না।

এভাবে আমরা যখন অপেক্ষা করছিলাম শুভমুহূর্তের জন্য, তখনই সে আচমকা আমাকে টেক্সট করে, ‘আজ ফোন দেব, শেষ ফোন।’ পাঁচ শব্দের একটা ছোট্ট ম্যাসেজ। পাঁচ সংখ্যাটিকে আমি ম্যাজিক্যাল সংখ্যা মনে করেছি সারা জীবন। আজ পাঁচ শব্দের একটি ছোট্ট ম্যাসেজ আমার জীবনটা ম্যাজিকের মতো পালটে দিচ্ছে।

সময় যেন স্থির হয়ে আছে। যেতে চায় না। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায়। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ আটকে রেখেছি। কিন্তু কোনো কিছু নেই। না কল, না টেক্সট। একসময় আহ্নিক গতি বার্ষিক গতি কাঁপিয়ে একটি কল আসে। আমি আমার সমস্ত কিছু দিয়ে সে-কল রিসিভ করি।

মুখরিত কথোপকথন শুরু হওয়ার আগে চুপকথা বা নৈঃশব্দ্য ছিল আমাদের ভাব বিনিময়ের ভাষা। এখন আবার শুরু হয়েছে সেই নৈঃশব্দ্য। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার নিঃশব্দ কান্না। আমারও। আমার মনের মধ্যে জন্ম নিয়েছে একটি বিশাল প্রশ্ন।

কেন? কেন আজকের ফোনটাই শেষ ফোন হবে? বলে ফেললাম সে-কথা।

কোনো উত্তর নেই। মৌনতা। আর নিঃশব্দ কান্না। এভাবে কিছুক্ষণ। তারপর জানাল সে কারণ। তার পরিবার আমার একটা দোষ খুঁজে পেয়েছে। দোষটা ক্ষমার অযোগ্য।

আমি শুধু তাকে একটি প্রশ্নই করেছিলাম, ‘আপনার কাছেও কি এই দোষ ক্ষমার অযোগ্য?’

সে বলেছিল, ‘এটা দোষ হবে কেন? এটা তো গুণ।’

কী ছিল সেই দোষ? কী ছিল সেই গুণ? যা ভেঙে দিয়েছিল আমার পৃথিবী!

তাঁরা জেনেছিলেন, আমি ছিলাম এক কবি।

[দিনাজপুর]

------

 

অশ্রু কারখানা | রনি অধিকারী
কেনারি দ্বীপে লরেল বৃক্ষছায়ায় রহমান সাহেব বসে আছেন। সুযোগ পেলে তিনি এই দ্বীপপুঞ্জে আসেন। সময় কাটান। কখনো-সখনো স্মৃতির গহিনে ডুব দেন। সাতাশ বছরে তিনি তার এক সহপাঠীকে বিয়ে করেন। বিয়ের তিন বছরের মাথায় স্ত্রী নিরুদ্দেশ। রহমান সাহেব চোখেও কম দেখেন। সবকিছু ঝাপসা মনে হয়। জার্মানির এক ডাক্তার তার চোখের চিকিত্সা করেন। প্রতিদিন দু চোখে কৃত্রিম অশ্রু দিতে হয়। এই কৃত্রিম অশ্রু কোথা থেকে আসে, কোন দেশে তৈরি হয়, রহমান সাহেব এর কিছুই জানেন না। জানার কথাও নয়।

কিছুদিন আগে রহমান সাহেবের একটা চিঠি এসেছে। পড়া হয়নি। এই নির্জন পরিবেশে রহমান সাহেব খাম খুলে পড়া শুরু করেন।

এলারগান কোং

৩০১ হার্বাড লেন, ডালাস, টেক্সাস

প্রিয় রহমান,

জানি, তুমি এখন কেনারি দ্বীপপুঞ্জে বসে, আমার চিঠি পড়ছ। আর আমি! তোমার থেকে ৭,৫০০ কিলোমিটার দূরে। মাঝে একটা আটলান্টিক মহাসাগর। ডালাসের লেক ভিউ পার্কে বসে আছি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানো—হোয়াইট স্টোন লেক, গ্রেফ ফাইন লেক এবং লেক আনলি—এই লেকগুলোর মাঝেই আমাদের কৃত্রিম অশ্রু কারখানা। খুবই নির্জন পরিবেশ। আমাদের হাইওয়েতে মকিংবার্ড ঘরসংসার পাতে। দেখতে খুবই সুন্দর লাগে। তুমি নিউইয়র্কে এলে ডালাসে এসো। প্লিজ। আর হ্যাঁ, তোমার ছেলে প্যারিসের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ওর অনেক নামডাক হয়েছে। আজ এখানেই বিদায় চাইছি।

ইতি,

নাজিয়া রহমান

রহমান সাহেবের চোখে এবার আচানক অশ্রু দেখা দেয়।

------

 

 

রংহীন নির্ভরতা | বিনিয়ামীন পিয়াস
মেয়েটার পেছনেই দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা। দুজনের কেউই মিরপুরগামী বাসটিতে বসার জায়গা পায়নি। গেটের একদম সামনেই ওরা দুজন দাঁড়ানো ছিল। মেয়েটার কাঁধে ছেলেটার হাত। শাহবাগ থেকে মাঝবয়েসি কয়েকজন লোক বাসে উঠলেন। অফিস শেষে বাড়ি ফিরছেন হয়তো। সারা দিন অফিস করে তাদের কারো কারো মেজাজ তুঙ্গে। সেরকমই একজন গজগজ করতে করতে বাসের পেছনের দিকে যেতে লাগলেন। তার রাগের কারণ বাসের সামনের অংশে দাঁড়ানো ঐ জুটি। ‘এহ, কাঁধে হাত দিয়া আবার সেইভ কইরা রাখছে, এত সেইভ করতে মন চায় যখন তাইলে পিছনে আইলেই পারে। সামনে দাঁড়াইয়া রইছে খাম্বার মতো। লোকজন উঠবে কই দিয়া!’ লোকটা বেশ উচ্চস্বরেই রাগ ঝারছেন।

আমি ছেলেটার দিকে তাকালাম। বাসের সামনের দিকে থাকা স্ট্যান্ডটা একহাতে ধরে অন্যহাত মেয়েটার কাঁধে রেখে যেভাবে দাঁড়িয়েছে তাতে বাসে ওঠার পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সদ্য প্রেমে পড়া জুটি বোধহয়! কলেজ বা ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ুয়া হবে বলে মনে হলো। মেয়েটা অন্যদিকে তাকানো, ছেলেটার মুখ দেখে কোনো অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। রাগারাগি করা লোকটার কথায় সে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমি আবার মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ ফেরালাম।

ফার্মগেটের কাছাকাছি আসতেই হেলপার যারা যারা নামবে তাদের গেটের কাছাকাছি যেতে বলল। আমি সিট ছেড়ে সামনে এগোলাম। গেটের সামনে পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে বললাম, ‘দেখি ভাই একটু।’

‘দাঁড়ান ভাই, আমিও নামব।’ ছেলেটা বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলল।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমার তেমন কোনো তাড়া নেই। বাস থেকে দু মিনিট দেরি করে নামলেও খুব বেশি ক্ষতি হবে না। ফার্মগেট এসে বাস দাঁড়াতেই মেয়েটাকে নামতে বলল ছেলেটা। মেয়েটা এপাশ ঘুরতেই তার চেহারা দেখতে পেলাম। ছেলেটা একহাতে শক্ত করে মেয়েটার হাত ধরল। আমার পেছনে থাকা কিছু অস্থির লোকজন ততক্ষণে চিত্কার শুরু করে দিয়েছে। আমি সেসবে কান দিলাম না। আমার দৃষ্টি মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তার আরেকটা হাত শূন্যে বাড়িয়ে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করল, তার দৃষ্টি একদিকে নিবদ্ধ, সে দৃষ্টি প্রাণহীন। ছেলেটা খুব সন্তর্পণে মেয়েটাকে বাস থেকে নামিয়ে নিল। ওদের প্রায় পিছুপিছুই আমিও নামলাম।

মেয়েটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। এই পৃথিবীর নানা রঙের আলো দেখার ক্ষমতা তার নেই। ঢাকার মতো এত বড় শহরে একা একা চলাটা তার জন্য বড্ড কঠিন। কিন্তু সেই কঠিন সময়ে তার কাঁধে হাত রেখেছে কেউ একজন। তাকে ভালোবাসতে পারে এমন এক নির্মল মনের মানুষ।

বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটার হাত শক্ত করে ধরে সাবধানে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে ছেলেটা। মেয়েটার এক হাতে একটা আইসক্রিম। হাঁটতে হাঁটতে ওরা কথা বলছে। ছেলেটার কোনো একটা কথা শুনে মেয়েটা হাসল, কী নির্ভার, নির্মল সেই হাসি!

মেয়েটা যদি জানত, তার হাসি কতটা রঙিন, ঠিক এই পৃথিবীর মতো!

[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]

------

 

মেঘবাড়ির গল্প | আরিফুর রহমান
কলিংবেল বেজে উঠলে টিনএজ পেরোনো রিমঝিম দরজা খুলে ওর বান্ধবীকে দেখে আহ্লাদী গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী রে, তোর বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ভাইয়া কি রাজি হয়েছে আমার মেঘবাড়ি ড্রয়িং করে দিতে? মশাইয়ের সময়ের যা দাম!’

মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল অল্প হেসে একপাশে একটু সরে দাঁড়াল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ওর ভাইয়াকে দেখা গেল এবার!

সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় লাল হয়ে রিমঝিম আস্তে করে বলল, ‘সরি, সরি!...ভেতরে আসুন, প্লিজ।’

রিমঝিম সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না ভাইয়া, আমি কিন্তু মজা করে বর্ষাকে ওসব বলছিলাম।’

সোফায় বসে যুবকটি পূর্ণ চোখে রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইটস ওকে। তোমার হাতের এককাপ চা...তারপর না হয় মেঘবাড়ি বিষয়ক আলোচনা।’

চা এলো। চায়ে চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্ত ও পূর্ণ চোখে আবারো রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে যুবকটি—বাদল—এবার জিগ্যেস করল, ‘তুমি তো রিমঝিম, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়াতেই তোমার আনন্দ, তাহলে মেঘের ভেতর বাড়ি...কেন?’

বর্ষা মনে মনে খুশি হলো। নাও গল্পকন্যা রিমঝিম আহমেদ এবার আমার ভাইয়ার কৌতূহল মেটাও।

আমি ওর সঙ্গে যুক্তিতে কখনো পেরে উঠি না এটা তুমি জানো।

বাদলের ঠিক পেছনের দেয়ালে রিমঝিমের বাবার ছবি ঝুলছে। রিমঝিম সেই ছবির দিকে তাকিয়ে মমতামাখা গলায় উত্তর দিল, ‘বাবা, আমার সুপার হিরো, আকাশে থাকেন! মেঘবাড়িটা তাঁর জন্য বানাব।’

‘ইন্টারেস্টিং!’ বর্ষার দিকে ইঙ্গিত করে বাদল আরো বলল, ‘ও অবশ্য কিছুটা বলেছে, কিন্তু পুরোপুরি বোঝাতে পারেনি মানে ওর ব্যাখ্যা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি।’

বাদলের আড়ালে বর্ষা ওকে একটু ভ্যাঙাল। সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রিমঝিম বাদলের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আপাতদৃষ্টিতে যেটা অযৌক্তিক মনে হয় তার পেছনেও অনেক যুক্তি থাকে। বিতর্কের মঞ্চে এই ব্যাপারটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি জয় এনে দিয়েছে। তাতে অনেক প্রতিষ্ঠিত এবং যৌক্তিক বিষয়ও স্রেফ ভেসে গিয়েছে, জানেন?’

বাদল কি একটু চমকাল? রিমঝিমের অমন দৃঢ় উচ্চারণ কি ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল ওর অপরিচিত কোনো গন্তব্যে? ওর অভিব্যক্তিতে সেটা যেন স্পষ্ট হতে গিয়েও হঠাত্ মিলিয়ে গেল।

বারান্দার দিকে তাকিয়ে রিমঝিম বলল, ‘মেঘবাড়িতে এরকমই একটা ঝুলবারান্দা রাখবেন প্লিজ, বাবা পছন্দ করতেন। আর বারান্দার শেষদিকটা থেকে একটা সিঁড়ি ঝুলিয়ে দেবেন; ইচ্ছে হলেই বাবা যেন এ-বাড়িতে নেমে আসতে পারেন।’

এই প্রথম যেন কথার খেই খুঁজে পেল বাদল। স্বরে গাঢ়তা ঢেলে বলল, ‘নিশ্চয়ই তোমার এমন অসাধারণ চা খেতে....!’

রিমঝিম হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ভেজা চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকাল বাদলের দিকে। দেখল ওর দুচোখে অপার মুগ্ধতা এবং সব ভুলে নিজেও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারল না!

[জামালপুর]

------

 

দ্য উইংকস অব ভাইব্রেন্স | রফিকুল নাজিম
একটি বড় চা বাগানের ম্যানেজার অনিন্দ্য। বাংলোর দোতলার গেস্টরুমটা তার খুব চেনা। এ নিয়ে সে এগারোবার উঠেছে এখানে। অনেকটা ব্রিটিশদের কায়দায় বাংলোটা সাজানো। হঠাৎ গেস্টরুমের দরোজায় কড়া পড়ল। অনিন্দ্য বুঝতে পেরেছে কে কড়া নেড়েছে! সাজলি মুন্ডা। ম্যানেজারের রন্ধন-শিল্পী। খুবই বিনয়ী ও অনুগত।

—ছাব, বড় বাবু আপনেকে ডেকে পাঠাইচে।

—যাও। আমি আসছি।

নতুন ম্যানেজার এসেছে মাস দুয়েক হয়। অনিন্দ্যর সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি। অথচ ভদ্রলোক কী সুন্দর আয়োজন করে রেখেছে। এখন আবার ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের নিমন্ত্রণ। দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে যায় অনিন্দ্য। ডাইনিংরুমটাও বেশ পরিচিত অনিন্দ্যর। বারান্দা দিয়ে হেঁটে যেতে হয় কিছুদূর। হঠাত্ অনিন্দ্যর চোখ আটকে গেল টিলার ঢালে। বাগানে এখন অন্ধকারের রাজত্ব। চা পাতার নিচে নিকষ কালো আঁধারের মজমা জমেছে। জোনাকিপোকাগুলো তারার মতো মিটিমিটি করে জ্বলছে। উত্তর দিকে দূরের এক টিলায় উত্সবের রং লেগেছে। আদি একটা সুর ভেসে আসছে উত্তরের হাওয়ায়। চা বাগান সত্যি এক অদ্ভুত সুন্দর জগত্। বৈচিত্র্যময়। ডাইনিংরুমে ঢুকতেই ভিরমি খায় অনিন্দ্য। পুরো রুম অন্ধকার। টিমটিম করে ডাইনিং টেবিলে তিনটে মোমবাতি জ্বলছে। আলো-আঁঁধারির অদ্ভুত এক ঘোরলাগা আবহ। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছেন সম্ভবত ম্যানেজার সাহেব।

অনিন্দ্যের দিকে একটু এগিয়ে এসে করমর্দন করে নিজ আসনে বসলেন তিনি। বসে টুকটাক কথা চালাচালি হচ্ছে। হঠাত্ একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে ডাইনিংরুমে। অনিন্দ্যের খুব পরিচিত ঘ্রাণ। কিন্তু ঘ্রাণের পরিচয় ও উত্সস্থল আবিষ্কার করতে পারছে না।

ভেতরের ঘর থেকে ডাইনিংরুমে ধীর পায়ে আসে ম্যানেজারের ওয়াইফ। স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হয় অনিন্দ্য। জেরিনের গায়ের সেই ঘ্রাণ কেন এই চা বাগানে? ক্যান্ডেল লাইটের আলোকে অতিক্রম করে অনিন্দ্য তার বরাবর ওপাশের চেয়ারের বসা নারীর দিকে তাকায়—হঠাত্ই তার বুকের ভেতর ঘুমন্ত একটা পাখি পাখনা ঝাপটিয়ে উড়তে চাচ্ছে। একেই বুঝি বলে নিয়তি! দ্য উইংকস অব ভাইব্রেন্স! অথচ এই পাখিটাই অনিন্দ্যকে বৈরাগ্য দিয়েছে। পৃথিবীর সব পাখির কাছে সঁপে দিয়েছে। ম্যানেজারের কথায় অনিন্দ্যের ভাবনায় ছেদ পড়ে।

—মিস্টার অনিন্দ্য, শি ইজ মাই বিলাভড পার্টনার; জারিন। জারিন, হি ইজ এ ওয়ার্ল্ডলি ওয়েল রিকগনাইজড ফটোগ্রাফার অব দ্য বার্ডস।

—হাই, মিস্টার অনিন্দ্য। ইউ আর ওয়েলকাম টু আওয়ার ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড।

—হ্যালো, জেরিন, আমি তো অনাহূত এক পরিযায়ী পাখি। তাও ওয়েলকাম করবেন?

—মিস্টার অনিন্দ্য, শি ইজ নট জেরিন; কল জারিন।

অনিন্দ্য মুচকি হেসে বলল, হুম। জারিন।

দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। দেয়ালে ঝোলানো পেন্ডুলাম ঘড়ির মতো আজকের রাতটাও যেন কোথাও আটকে আছে। কাঁটা এগোয় না। এখন পালাতে চাইছে অনিন্দ্য। নিজেকে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো মনে হচ্ছে। ছটফট করছে সে। স্মৃতিরা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ওদিকে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার বসে আছে টেবিলে। অনিন্দ্যের বুকে একটা গোপন পাখির ডানার ছটফটানি বেড়েই চলেছে। সেই পাখির ডানার আঘাতে রক্তাক্ত হচ্ছে অনিন্দ্যের হূদপিণ্ড।

[মাধবপুর, হবিগঞ্জ]

------

 

অনৃতকণ্ঠী | মো. মোখলেছুর রহমান
দশ টাকার নোটে একটি নম্বর পেয়ে শখের বশে ফোন করে বসে পিয়াস। প্রথমবার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার একটি সম্ভ্রান্ত প্রমিত উচ্চারণে নারীকণ্ঠে উত্তর এলো—কে বলছেন?

পিয়াস নিরুত্তর।

পিয়াস নিশ্চিত এ নারীর বয়স চল্লিশের কোঠায়।

রাত ঠিক দশটায় ঐ নাম্বার থেকে আবারও রিপ্লাই এলো। পিয়াস—জি বলেন।

এবারেও নারী কণ্ঠ ভেসে এলো। তফাত শুধু বয়সের। এ কণ্ঠের বয়স সর্বোচ্চ কুড়ি।

পিয়াস নাম জানতে চাইলে বলল—পিয়াসা।

পিয়াস একগাল হাসল।

—হাসির কী পেলেন?

পিয়াস হাসির রেশ রেখেই উত্তর দেয়, কাকতালীয়ভাবেই আপনার নামের সাথে আমার নামের দারুণ মিল। আমি পিয়াস।

—বলেন কী? তা পিয়াস সাহেব কি এখনো ব্যাচেলার?

—নোটিশ না দিয়ে বিয়ের খবর চাইছেন, বিয়েটিয়ে করতে চান নাকি?

—চাই বটে, চাইলে কি আর পাওয়া যায়? রবিবাবু বলেছেন না—যা পাই তা ভুল করে পাই, যা চাই তা পাই না।

—বাহ! সাহিত্যও তো বেশ জানেন।

—অল্প কিছু।

হাসল নারীকণ্ঠ, হাসি তো নয় নদীর ভাঙন, পাড়ভাঙা ভাঙন। এরপর থেকে সময়ে অসময়ে নানা সময়ে খুনসুটি চলতে থাকে পিয়াস-পিয়াসার। মন দেওয়া-নেওয়া চলল, জানাজানি হলো মানামানি হলো, অনেক দিন গত হলো।

একদিন দুজন মিলে ঠিক করল মুখোমুখি হবে, আর কত! স্থান রমনা পার্কের উত্তর দিকের চার নম্বর বেঞ্চ। যে আগে আসবে তাকে বসে থাকতে হবে।

পিয়াসা যথাসময়ে এলো, মোবাইল সাইলেন্স রাখল। বেশ কিছুক্ষণ পর তার অর্ধেক বয়সি একটি ছেলে হন্তদন্ত হয়ে তার বেঞ্চের দিকে ছুটে এলো। বেঞ্চিতে চল্লিশোর্ধ মহিলাকে দেখে পিয়াস কল দিতে শুরু করল। বার দুয়েক কল দিল, কিন্তু রিসিভ হলো না। পিয়াসা বুঝতে পারল এ ছেলেই পিয়াস। নিজ থেকেই জানতে চাইল—কাউকে খুঁজছেন?

—হ্যাঁ আন্টি, একটি মেয়ে আসার কথা ছিল।

—হ্যাঁ কিছুক্ষণ আগে একটি মেয়ে এসেছিল, হয়তো আপনার দেরি দেখে এখুনি চলে গেল।

পিয়াসের রাগে গড়গড় করতে লাগল।

রাতে পিয়াসার নম্বরে ফোন করল পিয়াস। নারীকণ্ঠে উত্তর এলো, পিয়াস আমি কালকের বেঞ্চিতে বসা তোমার আন্টি বলছি...!

[দিনাজপুর]

------

 

অপেক্ষা | মিরাজুল সেখ
কথা ছিল কৃষ্ণচূড়ার ডালে ফুল ফুটলে, বসন্তের পাতা ঝরলে ফিরবে। তাই দক্ষিণের জানালা খোলাই ছিল, চোখ পড়েছিল মেঠো রাস্তায়। অধীর আগ্রহে বাসা বেঁধেছিল মন। ঘরে ছিটকিনি দিয়ে লেখা হয়েছিল ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা’, কুলুঙ্গিতে রাখা হয়েছিল সিঁদুরের কৌটো, আর ছিল যত্নের শেষ সম্বল ‘বেনারসি শাড়ি’।

দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে, ঘুরতে থাকে ঋতুর চাকা। কথার সুর বয়ে নিয়ে আসে বাতাসে, প্রজাপতির রঙিন ডানা এসে উড়ে যায়। উদাস আকাশ আনমনা হয়ে মেঘ আঁকে। গোধূলিবেলায় নতুন কার বধূ ঘোমটা এঁটে পালকি করে যায়। চঞ্চল মন খামখেয়ালি হয়ে ছুটতে থাকে, অদৃশ্য ছায়ার পিছু পিছু।

অপেক্ষার আড়ালে প্রেমের শৈথিল্য ভর করে বসে। দিনের শেষে সব এলোমেলো হয়ে যায়। অন্ধের মতো শুধু চেয়ে থাকে মন। পঞ্জিকার পাতায় কালো কালির দাগ পুরু হয়ে জমাট বাঁধে, ভোরের আলোয় কোকিলের কলতান মুখর করে, ডাক দেয় জোয়ারের জল, হামাগুড়ি দেয় তার প্রতিকৃতি ধরা যায় না।

কথাগুলো জবাবদিহি করতে থাকে। বাঁকা ঠোঁটের কদর্য শুকনো মনে হয়। অপেক্ষার অন্তরালে পুড়তে থাকে প্রাণ, দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিত্কার করে। চাঁদের জ্যোত্স্না ফিকে মনে হয়।

তবুও প্রেমের আল্পনা আঁকতে আঁকতে ভোর হয়ে যায়। পালাবদল ঘটল সময়ের। আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা ধীরে ধীরে ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। প্রতিশ্রুতির গাঁটে মরচে ধরল। হাহাকার করে উঠল আশারা। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল সত্যতার আয়না। ভূপাতিত হলো প্রেমের বাস্তুতন্ত্র।

বসন্ত পেরিয়ে আবার ফিরে এলো। ফুল ফুটল কৃষ্ণচূড়ার শাখে। শুকনা পাতা ঝরল ভোরের বাতাসে, কোকিল ডাকল, শুধু পড়ে রইলাম আমি। ফিরল না নীলাঞ্জনা।

[মুর্শিদাবাদ]

ইত্তেফাক/এসটিএম