এমন অনেক পণ্য খাদ্যপণ্য আছে, যা কেবল একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই উত্পাদন হয়। ঐ একই পণ্য অন্য কোনো এলাকায় উত্পাদন হলে একই স্বাদ পাওয়া যায় না। যেমন, বগুড়ার দই, ইলিশ কিংবা দার্জিলিংয়ের চা। এসব পণ্যের গুণমান, স্বাদ-গন্ধ যেন এলাকার মাটি-জল-বায়ু ও মানুষের একান্ত নিজের। কেবল খাদ্যপণ্যই নয়, কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প বা শিল্পজাত অনেক পণ্যও রয়েছে, যেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে কোনো এলাকার একান্ত নিজস্ব। এমনকি ঐ এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ুর সঙ্গেও এসব পণ্য সম্পর্কিত। এসব পণ্যকে ঐ এলাকার পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থাই হলো ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন)।
ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বত্ব হলো কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের কোনো পণ্যকে তাদের নিজস্ব পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কোনো পণ্যের উত্পত্তিস্থল যদি ঐ ভৌগোলিক অঞ্চল হয়, সে দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উত্পাদনে ভূমিকা রাখে, সেই সঙ্গে, ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে পণ্যগুলোকে ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ঐ দেশের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পণ্যের গুণমান, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও খ্যাতির সঙ্গে এর উত্পত্তিস্থলের সরাসরি সম্পর্কের ভিত্তিতে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হলো মেধা-সম্পত্তি অধিকারের একটি কাঠামো, যা পণ্যকে কোনো একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অবস্থান থেকে উদ্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এটি সুনির্দিষ্ট করে যে পণ্যের গুণাবলি, খ্যাতি বা বৈশিষ্ট্যগুলো মূলত ঐ অঞ্চলের অধিকার। কৃষিপণ্য, খাদ্যদ্রব্য, হস্তশিল্প ও শিল্পজাত পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে জিআই প্রযোজ্য হয়।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, জিআই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সহায়তা ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া পণ্যের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেক দেশ জিআই নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষার জন্য আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে। আইনি কাঠামোতে রেজিস্ট্রি, মানদণ্ড নির্ধারণ করা ও প্রqোগকারী ব্যবস্থার রূপরেখা থাকে। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস অরগানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম অনুসরণ করে এই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিতে হয়। বাংলাদেশের প্রথম পণ্য হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। এই তালিকায় এখন পর্যন্ত ৩১টি পণ্য রয়েছে, যার সর্বশেষ বৃহস্পতিবার যুক্ত হয়েছে যশোরের খেজুরের গুড়, রাজশাহীর মিষ্টি পান ও জামালপুরের নকশিকাঁথা। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রংপুরের হাঁড়িভাঙা আম, মৌলভীবাজারের আগর, আগর আতর ও মুক্তাগাছার মন্ডাকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এরও একদিন আগে টাঙ্গাইল শাড়ি, নরসিংদীর অমৃতসাগর কলা ও গোপালগঞ্জের রসগোল্লার জিআই অনুমোদনের কপি ও জার্নাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।
২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় জামদানি শাড়ি। এগুলো ছাড়াও জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন পাওয়া পণ্যগুলো হলো বাংলাদেশের ইলিশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম, বিজয়পুরের সাদা মাটি, দিনাজপুর কাটারিভোগ, বাংলাদেশের কালিজিরা, রংপুরের শতরঞ্জি, রাজশাহী সিল্ক, ঢাকাই মসলিন, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি, বাংলাদেশের শীতলপাটি, বগুড়ার দই, শেরপুরের তুলশীমালা ধান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম, আশ্বিনা আম, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, বাংলাদেশের ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম, কুমিল্লার রসমালাই ও কুষ্টিয়ার তিলের খাজা।
আন্তর্জাতিক চুক্তি ও জাতীয় আইন অনুসারে জিআই পণ্য সুরক্ষা পেয়ে থাকে, যেমন (১) ভৌগোলিক নির্দেশক বা উত্পত্তির আবেদন রক্ষায় বিশেষ আইন (২) কালেক্টিভ ট্রেড মার্ক বা সার্টিফিকেশন মার্ক আকারে ট্রেডমার্ক আইন (৩) অসম প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে আইন (প্রতিযোগিতা আইন) (৪) ভোক্তা সুরক্ষা আইন এবং (৫) ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআইকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট আইন।
মেধাসম্পদ স্বত্ব বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটসের (ডব্লিউআইপিও) পরিচালিত বেশ কয়েকটি চুক্তি জিআই সুরক্ষা দেয়। বিশেষ করে শিল্পসম্পদ সুরক্ষার জন্য ১৮৮৩ সালে অনুষ্ঠিত প্যারিস কনভেনশন এবং উত্পত্তির আবেদন সুরক্ষার জন্য লিসবন চুক্তি এবং সেগুলোর আন্তর্জাতিক নিবন্ধন। এছাড়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিওর) কাঠামোর মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব চুক্তি-ট্রিপসের ২২ থেকে ২৪ ধারা জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশকের সুরক্ষা দেয়।
২০১৩ সালের আগে বাংলাদেশে জিআই ট্যাগ বিষয়ে আইনি কাঠামো ছিল না। ঐ বছর ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন প্রণয়নের পর ২০১৫ সালে সম্পূরক বিধিমালা তৈরি হয়। এরপর আইন ও বিধিমালার অধীনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্যাটেন্ট, শিল্প-নকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার আহ্বান জানায়। আইন অনুযায়ী, জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ ও তথ্য-উপাত্তসহ কোনো ব্যক্তিসংঘ, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনকে ডিপিডিটিতে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্র পরীক্ষানিরীক্ষা করে কোনো ভুলভ্রান্তি থাকলে পরিবর্তন বা সংশোধনের জন্য আবেদনকারীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আবেদনপত্রের সঙ্গে যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বিবেচনা করার পর সব ঠিক থাকলে জিআই জার্নালে প্রকাশ করা হয়। জার্নালে প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ যদি সেই পণ্যের বিরোধিতা করতে চায়, তাহলে তার জন্য সর্বোচ্চ দুই মাস সময় ধরা আছে। এসব কিছুর সর্বশেষ ধাপ হলো জিআই সনদ বা নিবন্ধন সার্টিফিকেট প্রাপ্তি। আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশন’-এর (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে ডিপিডিটি জিআই নিবন্ধন দিয়ে থাকে। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা বাংলাদেশে জিআই পণ্য হাতেগোনা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জিআই পণ্যের স্বীকৃতিতে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, যা আশাব্যঞ্জক নয়। পিছিয়ে থাকার কারণ হলো এ দিকটাতে মনোযোগ নেই। জিআই পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের ফলে দেশে পর্যটন ও রপ্তানি বাড়ে, কৃষক, উত্পাদক ও ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। এসব পণ্য ক্রেতারা বাড়তি দাম দিয়ে কিনতেও রাজি থাকেন। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে সেটিকে বৈশ্বিকভাবে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে ঐ পণ্যের বাড়তি কদর তৈরি করা সম্ভব হয়। এর ফলে বাড়তি চাহিদা তৈরি হলে ঐ পণ্যের উত্পাদনও বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। জিআই সনদ থাকলে সেই পণ্যের বাণিজ্যিক উত্পাদনের অধিকার ও আইনি সুরক্ষাও ঐ দেশের অধীনেই থাকে। অন্য কোনো দেশ তখন ঐ পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব দাবি করার সুযোগ পায় না। ফলে উত্পাদকের বাণিজ্যিক বা আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়।