রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। আগুনের লেলিহান শিখায় কারো পুড়েছে স্বপ্ন, কারো পুড়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-শিল্প কারখানা। আগুনের ভয়াবহতায় নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে সারাদেশে মোট ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে প্রতিদিন ৭৭টি আগুন লেগেছে। এসব ঘটনায় সারাদেশে মোট ২৮১ জন আহত এবং ১০২ জন নিহত হয়েছেন। এতে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের সম্পদ। এসব নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান।
ইত্তেফাক: দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস বা রমজানের সময় আগুন লাগার ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আবাসিক, রেস্তোরাঁ, মার্কেট বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন কেন মৌসুম ভেদে লাগছে?
ড. জিল্লুর রহমান: সাধারণত গ্রীষ্মে আবহাওয়া শুষ্ক থাকে, জলীয়বাষ্প বা আদ্রতা খুবই কম থাকে, সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং শুষ্ক মৌসুম পানিও কম থাকে। এটি স্থায়ী হয় চৈত্র, বৈশাখ, ফাল্গুন পর্যন্ত। আগেও গ্রামে এ সময় আগুন বেশি লাগত। ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে এই চার মাস এসব কারণেই আগুন সবচেয়ে বেশি লাগে। এছাড়া এ সময় বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়ে যায়। এতে বিদ্যুতের ওপর বেশি চাপ পড়ে। এজন্য এসময়টাই আগুন লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ইত্তেফাক: দেখা গেছে, এক জায়গায় আগুন লাগলে পরপর একাধিক আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. জিল্লুর রহমান: আগুন পর্যায়ক্রমে লাগে না। কারণ এই সময়টাই আগুন বেশি লাগার সময়। ঢাকা অপরিকল্পিত ও ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি এসবগুলোতেই এ সময়টাই চাপ বেশি পড়ে। এসময় ফ্যান, ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশন, মোটরের ব্যবহার বেড়ে যায়। এতে বিদ্যুতের ওপর চাপ পড়ে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকিও বেড়ে যায়। উন্নত দেশে সব কিছু উন্নত থাকার পরেও দেখবেন গ্রীষ্মে প্রচুর আগুন লাগে এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটে। আবার আদ্রতা বেড়ে গেলে আগুন লাগাও কমে যায়। সুতরাং এটি কোনো পর্যায়ক্রম ঘটনা না। এটি এই সিজনেরই ওপর নির্ভর করে।
ইত্তেফাক: অগ্নিকাণ্ড এড়াতে বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবন নির্মাণে কী কী বিষয়ে নজর রাখতে হবে?
ড. জিল্লুর রহমান: ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে আবাসিক, বাণিজ্যিক, হোটেল ও রেস্তোরাঁ প্রতিটি ভবনের আলাদা ফায়ার সেফটির সব শর্ত মেনে ভবন নির্মাণ করতে হবে। হোটেল-রেস্তোরাঁ ভবন নির্মাণে ফায়ার সেফটির ওপর বেশি নজর দিতে হবে। কেননা এটি ঝুঁকিপূর্ণ বেশি। কিন্তু আমরা তা করি না। উন্নত দেশে প্রত্যেকটা বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচারের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি ফ্লোরে নরমাল সিঁড়ি, লিফট, ইমার্জেন্সি এক্সিট দিতে দেখা যায়। স্কুল, কলেজ, আবাসিক ভবনগুলোতে বছরে দুইবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ফায়ার ড্রিল করায় এবং আগুন লাগলে কীভাবে লোক বেড়িয়ে আসবে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এগুলো নির্দিষ্ট করা থাকে।
ইত্তেফাক: অগ্নিকাণ্ড রোধে রেস্তোরাঁয় সিলিন্ডার গ্যাসের বিকল্প অন্য কী ব্যবহার করা যেতে পারে?
ড. জিল্লুর রহমান: লাইনের গ্যাসের নতুন সংযোগ না দেওয়ায় সিলিন্ডার গ্যাসের বিকল্প আপাতত আমি দেখছি না। তাই সিলিন্ডারের মান নিশ্চিত করতে হবে। এতে দুর্ঘটনা অনেকটাই এড়ানো যাবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের আইন বা বিধিমালাগুলো দ্রুত আপডেট করে কার্যকর করতে হবে, তা না হলে এরকম আগুন পরপর লাগবেই। যেমন গার্মেন্টসে আগে প্রচুর আগুন লাগতো। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গার্মেন্টস সেক্টরে সেফটি বিবেচনায় ভবন নির্মাণ বেড়েছে এবং এতে দুর্ঘটনাও কমে গেছে। সম্প্রতি বেইলি রোডে রেস্তোরাঁয় আগুন লেগে এতো্ মানুষ মারা গেল। এসব ঘটনা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা।