ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হওয়া চার ইউরোপীয় দেশকে সতর্ক করেছে ইসরায়েল। সোমবার ইসরায়েল দেশগুলোকে বলেছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে তাদের পরিকল্পনা সন্ত্রাসবাদের পুরস্কার হবে। যা আলোচনার মাধ্যমে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাত অবসানের সুযোগ কমিয়ে দেবে।
এদিকে গাজায় আরও দুটি হাসপাতাল অবরোধ করেছে ইসরায়েল। গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েল বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)।
অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, রাফাহ থেকে জোর করে মানুষকে স্থানান্তর করা হবে যুদ্ধাপরাধের শামিল।
স্পেন শুক্রবার ঘোষণা দেয়, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের দ্বারা ঘোষিত রাষ্ট্রকে স্বীকৃতির দিতে প্রথম পদক্ষেপ নিতে আয়ারল্যান্ড, মাল্টা এবং স্লোভেনিয়ার সঙ্গে তারাও সম্মত হয়েছে। গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠি হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে তাদের হামলা দীর্ঘ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। গাজায় যুদ্ধের প্রভাবে পশ্চিম তীরেও সহিংসতা বেড়েছে। ইসরায়েলের দখলে থাকা পশ্চিম তীরে ব্যাপক ইহুদি বসতি রয়েছে।
ইউরোপের ৪ দেশের ঘোষণার পর ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাত্জ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, ৭ অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া হামাস ও অপর ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে একটি বার্তা দেবে। আর তা হলো, ইসরায়েলিদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার জন্য ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক পুরস্কার দেওয়া হবে। তিনি লেখেন, সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই কেবল এর অবসান সম্ভব। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে কোনও উদ্যোগ এমন সমাধানকে দূরবর্তী এবং আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে। তবে কোন ধরনের সমাধানের কথা তিনি বিবেচনা করছেন তা উল্লেখ করেননি। ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন জোটে তার নেতৃত্বে বসতিপন্থি উগ্র ডানপন্থিরা রয়েছেন। তারা দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে এই বিষয়ে ইসরায়েলের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।
এদিকে গাজায় আরও দুটি হাসপাতাল রোববার অবরোধ করে ইসরায়েলি সেনারা। এতে তুমুল গোলাগুলির মধ্যে আটকা পড়েছেন চিকিত্সাকর্মীরা। হামলার মুখে একটি হাসপাতাল থেকে রোগী ও অশ্রয় নিয়ে থাকা মানুষদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট। গাজার হাসপাতালগুলোকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে বলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করে আসছে। তবে হামাস ও হাসপাতাল কর্মীরা এমন অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস নগরীতে গোলা হামলা চলার মধ্যে আল-আমাল ও নাসের হাসপাতালের আশেপাশে একটি ইসরায়েলি ট্যাংক হুট করে ঢুকে পড়ায় তাদের এক কর্মী নিহত হন।
এক বিবৃতিতে দাতব্য সংস্থাটি বলেছে, আল-আমাল হাসপাতাল ঘিরে ফেলে ইসরায়েলি সেনারা বুলডোজার দিয়ে অভিযান চালাচ্ছে। আমাদের সব কর্মী এ মুহূর্তে চরম বিপদের মধ্যে আছে। কারণ, তাদেরকে বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালটিতে কর্মী ও রোগীদের পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত মানুষেরাও আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাদেরকে বের করার জন্য ইসরায়েল স্মোক বোমা ছুড়ছে।
এছাড়া খান ইউনিসের বাসিন্দারা বলেছে, ইসরায়েলি বাহিনী আরও এগিয়ে গিয়ে নগরীর পশ্চিমাঞ্চলের নাসের হাসপাতাল চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। স্থলভাগ থেকে ভারি গোলা ছুড়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে। ইসরায়েল এর আগে গাজার প্রধান আল শিফা হাসপাতালে অভিযান চালায়। আল শিফার পরই খান ইউনিসের হাসপাতাল অবরোধ করল ইসরায়েলি সেনারা। এছাড়া গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েল বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)।
জাতিসংঘের এই সংস্থাটির প্রধান ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘকে জানিয়েছে, তারা উত্তরে আর কোনো ইউএনআরডব্লিউএ-এর খাদ্যবাহী কনভয় প্রবেশ করার অনুমোদন দেবে না। এই ধরনের পদক্ষেপ আপত্তিজনক এবং একইসঙ্গে এটি মানব-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সময় জীবনরক্ষাকারী সহায়তা সরবরাহে বাধা দেওয়ার ইচ্ছাকেই সামনে তুলে ধরছে।
ইউএনআরডব্লিউএ মুখপাত্র জুলিয়েট তোমা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে গাজার উত্তরে সহায়তা ডেলিভারির জন্য লিখিতভাবে দুবার অস্বীকার করার পর রোববার ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে এই ধরনের সিদ্ধান্তের কোনো কারণ জানানো হয়নি বলেও জানান তিনি। তোমা বলেন, গত ২৯ জানুয়ারি থেকে ইউএনআরডব্লিউএ গাজার উত্তরে খাদ্য সরবরাহ করতে পারেনি। তিনি বলছেন, সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো কফিনে আরেকটি পেরেক। জাতিসংঘের মতে, ইসরায়েলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকটের মধ্যে গাজার সকলেই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ না করা হলে আগামী মে মাসের মধ্যে গাজার উত্তরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার প্রায় সকল অঞ্চলে ধ্বংসলীলা চালিয়ে ইসরায়েলের নজর এখন রাফাহ শহরের দিকে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দক্ষিণ গাজার এই শহরটিতে হামলার অনুমতিও দিয়েছে নেতানিয়াহু সরকার। এমন অবস্থায় রাফাহতে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, রাফাহ থেকে জোর করে মানুষকে স্থানান্তর করা হলে তা হবে ‘যুদ্ধাপরাধ’। বলা হয়েছে, দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহর থেকে লোকেদের জোরপূর্বক অন্যত্র স্থানান্তর করা হলে সেটিকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে গণ্য করা হবে বলে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে জানিয়ে দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এসময় তিনি রাফাহতে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের বিষয়ে তার বিরোধিতারও পুনরাবৃত্তি করেন। মূলত টানা প্রায় ছয় মাসের ইসরায়েলি আগ্রাসনের মধ্যে গাজার বেশিরভাগ মানুষ এই অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। বলা হচ্ছে, রোববার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। আর সেখানেই তাকে এসব কথা জানিয়ে দেন ফরাসি এই প্রেসিডেন্ট। এছাড়া এই টেলিফোন কলে নতুন বসতি স্থাপনের জন্য অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৮০০ হেক্টর জমি দখলে গত শুক্রবার ইসরায়েলের দেওয়া ঘোষণারও ‘কঠোর নিন্দা’ জানান ম্যাক্রোঁ।
ফোনকলে ম্যাক্রোঁ নেতানিয়াহুকে বলেন, তিনি ‘অবিলম্বে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি খসড়া প্রস্তাব আনতে চান। একইসঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজায় সমস্ত ক্রসিং পয়েন্ট খুলে দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে, ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, হামাসকে ধ্বংস করার জন্য এই অভিযান চালানো প্রয়োজন। অবশ্য ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার শেষ নিরাপদস্থল রাফাহতে হামলার অনুমোদন ইতোমধ্যেই দিয়েছে দখলদার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। গত ১৫ মার্চ যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়।