অভাবনীয় উন্নতি সত্ত্বেও এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখনো মানুষের বশে রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে সেই প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের বন্ধন ও আবেগের সম্পর্কের সম্ভাবনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
প্রথমে বান্ধবী ও পোষা প্রাণীর এআই সংস্করণ এসেছিল। এবার চীনের গবেষকরা এআই শিশু সৃষ্টি করেছেন! বেইজিং ইনস্টিটিউট ফর জেনারেল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেই ভার্চুয়াল চাইল্ড সৃষ্টি করেছে। সেই অবতার স্বাভাবিক সংলাপ চালাতে পারে, কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট বুঝতে এবং সংলাপের সময়ে সামঞ্জস্যও বজায় রাখতে পারে।
চ্যাটজিপিটি-ও তো সেই কাজ করতে পারে। কিন্তু টং টং-এর বৈশিষ্ট্য হলো, সে শিখতে, মানিয়ে নিতে এবং নিজের ভার্চুয়াল পরিবেশের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করতে পারে। এমনকি মানুষের আবেগ শনাক্ত করে প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারে।
এক পরীক্ষায় তার সহজ কিছু ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেল। পড়ে যাওয়া তরল পরিষ্কার, বেঁকে যাওয়া ছবির ফ্রেম মেরামতি বা উঁচু জায়গায় চেয়ার নিয়ে যাওয়া তার জন্য কোনো সমস্যাই নয়। মানুষের নির্দেশ ছাড়াই স্বতন্ত্রভাবে এমন কাজ চলছে।
কোনো একদিন সে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স বা এজিআই আয়ত্ত করবে বলে তার স্রষ্টারা আশা করছেন। অর্থাৎ সেই এআই-এর মধ্যে মানুষের সব বৈশিষ্ট্য থাকবে। যেমন স্বতন্ত্রভাবে কগনিশন বা জ্ঞান গ্রহণ করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, সামাজিক স্তরে আদানপ্রদান ও আবেগ।
‘জারভিস’ নামে আয়রন ম্যানের সহকারীকে মনে আছে? টং টং-এর মতো প্রোগ্রাম সেই দিশায় প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু সেটিকে শিশু হিসেবে তুলে ধরা কিছুটা অদ্ভুত নয় কি?
ডেভেলপারদের মতে, পুরোপুরি উন্নত এজিআই যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো হয়, তাহলে টং টং-এর ক্ষমতা চার বছর বয়সি শিশুর সঙ্গে তুলনীয়। তাছাড়া শিশুর মতো চেহারার পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। মানুষ অতি বুদ্ধিমান এআই শুনলে ভয় পায়, কিন্তু শিশুদের ভালোবাসে।
আবার ‘জারভিস’-র প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এমন এক এআই সহকারীর কথা ভাবা যাক, যে একাধিক কাজ করতে পারে। সে আপনার হয়ে কোনো ইমেলের জবাব দেবে, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করবে, আপনি ক্লান্ত হলে কফিও তৈরি করে দেবে।
শুনতে খারাপ লাগছে না। কিন্তু এমন সব অ্যালগোরিদম শুধু পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এআই অনেক ক্ষেত্রে মানুষ কর্মীর বিকল্প হয়ে উঠবে। যেমন গ্রাহক পরিষেবা ও আর্থিক ক্ষেত্রে সে কাজ সামলাবে।
কিন্তু খেলাচ্ছলে চ্যাটজিপিটি ঘাঁটাঘাঁটি করে আমাদের একটা উপলব্ধি হয়েছে। আর সেটা হলো, অ্যালগোরিদম যতই উন্নত হোক না কেন, কখনো কখনো সেটি সম্পূর্ণ অর্থহীন বার্তা সৃষ্টি করে। অনেক সময়ে সেটা মানুষ বুঝতেও পারে না। কোনো এআই মডেল স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে ভুল করলে মানুষের জীবনও বিপন্ন করতে পারে।
চিকিৎসাশাস্ত্রের কথাই ধরা যাক। কোনো এজিআই সার্জারির সময়ে সহায়তা, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধান ছাড়া কোনো ভুল করলে রোগীর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক কুপ্রভাব পড়তে পারে।
ফলে আমাদের ঝুঁকি কমানোর পথ খুঁজতে হবে। সেইসঙ্গে অ্যালগোরিদমের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য প্রায় দূর হতে চলায় আমাদের এআই-এর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রথমদিকে এআই শিশু একটু অদ্ভুত লাগতে পারে বটে, কিন্তু যাদের নিজস্ব সন্তান পাওয়ার উপায় নেই, তাদের জন্য সেটা একটা পথ হতে পারে। অথবা যে বাবা-মায়েরা সন্তান হারিয়েছেন, তারা হয়তো এভাবে শোকের মাত্রা কিছুটা কমাতে পারেন। যথেষ্ট তথ্য থাকলে তারা এমনকি হয়তো হারানো শিশুর ডিজিটাল সত্তা সৃষ্টি করতে পারেন।
কিন্তু এ ক্ষেত্রেও এআই-এর ভুলত্রুটি থেকে সুরক্ষার কথা ভাবতে হবে। যেমন আপনার এআই শিশু আচমকা নিজের ব্যক্তিত্ব বদলে ফেললে কেমন লাগবে ভাবুন তো? অথবা সে পুরোপুরি কাজ বন্ধ করে দিলেও আপনার আবেগ বড় ধাক্কা খেতে পারে। তাছাড়া স্বাধীনভাবে চিন্তা ও আবেগ সৃষ্টি করতে সক্ষম কোনো এআই-এর সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নানা প্রশ্ন উঠে আসে।
নৈতিকতার বিচারে সেই এআই-কে শুধু এক যন্ত্র হিসেবে গণ্য করা উচিত, নাকি এআই-এর ‘অধিকার' সম্পর্কেও ভাবনাচিন্তা করা উচিত? এ সব কথা শুনে মাথা ঘুরে যাচ্ছে? কিন্তু আমরা কি আদৌ এমন ভবিষ্যৎ চাই?