বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

আফগানিস্তান ভ্রমণ

যেখানে তালেবানের ভয়...

আপডেট : ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৫

যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে পা রাখতে হবে ভেবেই বুকের ভেতর কেমন যেন আতঙ্ক কাজ করছিল। নারীদের জন্য কঠিন অবরুদ্ধ জীবন যেই দেশে, সেখানকার চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে কঠিনতম হবে তা জানাই ছিল।

ভিসার জন্য আমি পাকিস্তানের পেশাওয়ার ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত আফগানিস্তানের অ্যাম্বাসিতে আবেদন করি। এখানে ভিসা পাওয়া খুব সহজ ছিল। অ্যাম্বাসিতে প্রবেশের পরেই আমাকে আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানকার কর্তব্যরত এক নারী জানালেন, তালেবান ভিসা অফিসারের রুমে যাওয়ার জন্য আমাকে আফগানি বোরকা পরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে ঢেকে রাখতে হবে।

আফগানি বোরকা পরে তালেবান অফিসারের সামনে দাঁড়াতেই প্রশ্ন করা হলো, ‘আর ইউ মুসলিম?’ আমি বললাম ‘ইয়েস’। তারপর ভদ্রলোক আমাকে তালেবান ফাস্ট সেক্রেটারি অফিসারের রুমে নিয়ে গেল। মাথায় কালো পাগড়ি পরিহিত সেই অফিসার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘আফগানিস্তানে তুমি কতদিন থাকতে চাও, তুমি কী করো?’ আমি আমার বিশ্ব ভ্রমণের সামান্য ইতিহাস বর্ণনা করলাম। তালেবান অফিসার মুচকি হেসে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ্’। তিনি এক অফিসারকে ডেকে  নির্দেশ দিলেন আমাকে আজই ভিসা দিয়ে দিতে। আমি ১০০ ডলার ও ছবি দিলাম। আমাকে ঠিক আধা ঘণ্টার মধ্যে ভিসা দিয়ে দিলো। এমনকি, আমি সড়কপথে কীভাবে যেতে পারি সেই পরামর্শও তারা দিলেন। তৎক্ষণাৎ আমার মনে হলো তারা পর্যটকদের খুবই ওয়েলকামিং।

দু-দিন পর পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে সড়কপথে আমি পৌঁছে গেলাম আফগানিস্তানের বর্ডার তোরখামে। বর্ডারের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়, তাই এক বুক সাহস ও একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়েই পুরো পথ পাড়ি দিলাম। পথে পথে চেকপোস্ট বর্ডার সিকিউরিটি, ভিসা চেক, সবকিছু পার করতে দেড় ঘণ্টার মত সময় লেগে গেল। পাকিস্তান বর্ডারে যেতেই একের পর এক প্রশ্ন! ১০০০ ডলারের বেশি বহন করা যায় না, সেটার জন্য খেসারত দিতে হলো আফগান রুপিতে এক্সচেঞ্জ করে!

আফগানিস্তানে লেখক

বিকেল গড়িয়ে পড়েছে। আমি পাকিস্তানের বর্ডার পার হয়ে আফগানিস্তানের বর্ডারের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। দুই তালেবান অফিসার হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। তাদের এত সুন্দর আচরণ দেখে আমি খুবই অবাক। আমার কাছে আফগানিস্তানের সিম না থাকায় গাইডের সঙ্গে তাত্ক্ষণিক যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এক আফগানি ভদ্রলোক তার স্ত্রী ও দুই কন্যাসহ পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান যাচ্ছিলেন। আফগানি এই ভদ্রলোক আমাকে বললেন তুমি আমাদের সাথে জালালাবাদ পর্যন্ত চলো। আমি তাদের সাথে একই গাড়িতে জালালাবাদ রওনা হলাম ।

পথে পথে তালেবানের আতঙ্ক, বোমা হামলা ও অস্ত্রের ভয়! দু’পাশের ঘরবাড়ি পাহাড় দেখতে দেখতে এক সময় জালালাবাদের কাছাকাছি একটা মসজিদে গাড়িটি থামল। নীল রঙের সেই ছোট্ট মসজিদটিতে আমরা আসরের নামাজ পড়লাম। সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে এলো, তখন জালালাবাদ পৌঁছালাম। যেতে যেতে গাড়ির মধ্যে আফগানি নাজমুর রহমান ভাই ও তার পরিবারের সাথে অনেক কথা হলো। আমাকে তাদের বাসায় থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। যেহেতু সন্ধ্যা হয়ে গেছে, বিপদের আশঙ্কায় খাইবার পাস মাউন্টেন ক্রস করিনি। তাদের বাড়িতে রাত কাটাতে রাজি হয়ে গেলাম। নাজমুর রহমানের আরেক ভাই আফগানিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেটিং ম্যানেজার। তার বাড়িটি তিনতলা বেশ বড় ও খুব সুন্দর। প্রাঙ্গণে অনেক জায়গা এবং গেস্ট হাউস। সামনে বিশাল লন। ঘরের ভেতর সবাই কার্পেটের ওপর বসে একসাথে ইফতার করলাম।

ইফতারের পর আমরা মেয়েরা সবাই আফগানি বোরখা পড়লাম। নাজমুর ভাই আমাদের গাড়ি করে পুরো শহর দেখালেন। জালালাবাদ সিটি সেন্টার স্কয়ার বেশ সুন্দর। তারা আমাকে আফগানি ট্র্যাডিশনাল আইসক্রিম খাওয়ালো, এত অমৃত আইসক্রিম যেন আর কোথাও খাইনি! সে আইসক্রিম আমাকে গাড়ির মধ্যে বসে খেতে হলো। কারণ তারা বারবার আমাকে বলছে—কোনোভাবেই সন্ধ্যা-রাতে খোলা রাস্তায় ঘোরাঘুরি করতে পারব না। আহা, নারীদের জীবন এখানে এতই  অবরুদ্ধ! আমি বোরখার ভেতর থেকে দু’চোখ দিয়ে কোনোরকমে জালালাবাদ শহরের সৌন্দর্য দেখলাম। অপূর্ব সেই রাতের দৃশ্য, সবুজ গাছপালা, তাদের জীবনব্যবস্থা সবকিছুই আমাকে অভিভূত করল; একমাত্র নারীদের জীবনের কঠিন আইনি অবরুদ্ধ জীবন ছাড়া। রাস্তার আনাচে-কানাচে কোনো নারীকে হাঁটতে দেখতে পেলাম না।

এ পরিবারের একটা ফার্ম হাউস রয়েছে তাদের বেহশুত গ্রামে। পরদিন সকালে সেখানে গেলাম। আফগানি কোন গ্রাম দেখা আমার কাছে আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। উঁচু উঁচু পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমরা সেই গ্রামে পৌঁছালাম। যেতে যেতে গ্রামের মানুষের জীবনব্যবস্থা দেখলাম। বেহশুত গ্রামের মানুষ আমাকে দেখে অভিভূত হলো এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি আমাদের দেখতে এসেছ একজন নারী হয়ে এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ব্যাপার। এ দেশে তালেবানের ভয়ে পর্যটকরা আসতেই চায় না। তোমার সাহসকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’ এখানকার মানুষ সব অর্গানিক খাবার খায়। তাই জালালাবাদ শহর এবং এর আশেপাশের গ্রামগুলোর মানুষের স্বাস্থ্য, শরীর বেশ সুন্দর।

সবকিছু ঘুরে দুপুরের আগেই আমি রওনা হলাম কাবুলের উদ্দেশে। সন্ধ্যার আগে আমাকে পৌঁছে যেতে হবে। কারণ দুরন্ত খাইবার পাস দুর্গম মাউন্টেন ক্লাইম করে পৌঁছাতে হবে। দুপুর তখন বিকেলের দিকে আমি ইতিমধ্যে খাইবার পাসের রাস্তায় পৌঁছে গেছি। যেতে যেতে উঁচু উঁচু গাছপালাহীন পাথরের পাহাড়ের ভ্যালি আমাকে মুগ্ধ করল। ড্রাইভার আমাকে বলছে, এই পাহাড়ের কোনায় কোনায় তালেবান সৈনিকরা লুকিয়ে দেখছে কারা যাচ্ছে, তাই তুমি মুখ থেকে বোরখার পর্দা খুলবে না। এখানে যেকোনো সময় অস্ত্রের হামলা হতে পারে।

দেশটির নারীদের জীবন যেন দুর্গম পাহাড়ের চেয়েও কঠিন। এখানে নারীদের সোনালি স্বপ্নগুলো যেন অচিরেই মুষড়ে পড়ে। গাইড-ড্রাইভার আমাকে তাদের ইতিহাস ও বর্তমান সম্পর্কে অনবরত বলছেই। আমি বোরখার ভেতর থেকে দুই চোখ দিয়ে প্রকৃতির অমলিন সৌন্দর্য অবলোকন করতে থাকলাম। পাশেই বয়ে যাওয়া কাবুল নদীর স্রোতের গর্জন আমাকে আন্দোলিত করছে, অন্যদিকে গাড়ি থামিয়ে অসংখ্য চেকপোস্টে তালেবানরা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তালেবান পুলিশদের শরীরজুড়ে অসংখ্য আর্মস, দেখলে যেন আতঙ্কের স্রোত বয়ে যায়।

কাবুলে তখন সন্ধ্যার আজান হচ্ছে, আমি ‘আল্লাহুম্মা সুনতুলাকা’ পড়েই মুখে এক চিলতে পানি দিলাম। এরইমধ্যে গাড়ি কাবুল শহরের ভেতর পৌঁছে গেল। আমি আলো অন্ধকারের মাঝে কিছুক্ষণ শহরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই সেই কাবলিওয়ালাদের রাজধানী শহর, যেখানে বছরের পর বছর রক্তক্ষরণ, যুদ্ধবোমা পড়ে জনজীবন বিধ্বস্ত হয়েছিল। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর এখন তা বন্ধ হলেও মানুষের ভেতরে এখনো আতঙ্ক কমেনি।

কাবুলে গাইড মোস্তাক এবং তার স্ত্রী মুখাসার বাসায় আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। আফগানিস্তানের স্থানীয় মানুষের ব্যবস্থাপনায় থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। এতে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়। বাসার ভিতরে ঢুকে আফগানিস্তানের ফার্নিচার এবং কার্পেট মোড়ানো ড্রয়িং রুম আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমরা একসাথে ইফতার করলাম স্পেশাল আফগান স্পিনাস বোলানী ও হরেক রকমের খাবার দিয়ে।

সকাল হতে হতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাবুল ঘোরার জন্য। এর মধ্যে মোস্তাক আমাকে বেশ কিছু ইনস্ট্রাকশন দিলো তালেবান সম্পর্কে। চেক পয়েন্টগুলোতে কী ধরনের আচরণ করতে হবে তালেবানের সাথে। মুখ থেকে কখনো বোরখা-পর্দা খোলা যাবে না। যেখানে আমরা ছবি তুলব, সেখানে শুধু পর্দা খুলে ছবি তুললেই হবে, কোনো অসুবিধা হবে না।

আমি, মোস্তাক, মুখাসা, অরিন আমরা চারজন শহরের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম একটা গাড়ি নিয়ে। মোস্তাক ড্রাইভ করছে। আমি তার পাশে বসা বোরখার ফাঁক দিয়ে একটু করে শহর দেখতে থাকলাম এবং সামান্য ভিডিও করলাম গাড়ির ভিতর থেকে। যখন চেক পয়েন্ট আসে তখনই মোস্তাক আমাকে বলে দেয়— ‘এখন আর ভিডিও করা যাবে না’। একবার একটা চেক পয়েন্টে মোস্তাককে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি তার কে হই?’ মোস্তাক পরিকল্পনামতো বলল, ‘আমি তার চাচাতো বোন। ছোটবেলায় চাচার সঙ্গে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছি এবং এখন বড় হয়ে আফগানিস্তান দেখতে এসেছি।’ তালেবানরা তাতে খুশি হয়ে হাসিমুখে আমাদেরকে ছেড়ে দেয়।

এভাবে চেকপোস্ট পার হয়ে আমরা একটা পাহাড়ের নান্দনিক দৃশ্যের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। সেখানে মোস্তাক আমাকে বলল—এখন ভিডিও এবং ছবি তোলা যাবে। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে ছবি এবং ভিডিও করলাম। এরইমধ্যে কোথা থেকে যেন দুটো তালেবান সিকিউরিটির গাড়ি চলে এলো। মোস্তাক একটু আতঙ্কিত হয়ে আমাকে তার পেছনে রেখে তালেবানদের মুখোমুখি হয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ও আমার চাচাতো বোন....।’ তারপর তালেবানরা বলল কোনো অসুবিধা নেই।

এভাবে সারাদিন যেখানেই দর্শনীয় স্থানে গিয়েছি, সেখানেই তালেবান যেন গাড়ি ধাওয়া করেছে। এত কঠিন অবরুদ্ধ—একটু নিশ্বাস ফেলতেও যেন হাজারো প্রশ্ন এবং সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এখানে! তবুও তারা হাসছে, জীবনের সাথে যুদ্ধ করছে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষগুলো খুবই দরদি, খুবই আন্তরিকতায় ভরপুর তাদের হূদয়। মুখাসা, মোস্তাক এবং অরিন তিন দিন ধরে পুরো কাবুল এবং তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে এভাবে   আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। যেদিন আমি ফিরে আসব সেদিন আমাকে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি পর্যন্ত নিয়ে এলো। তাদের আন্তরিকতা ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

আমি তাদের কিছু পাউন্ডস দিলাম, তারা ভীষণ খুশি হয়েছে। মোস্তাকের বাবা একজন আফগানি পাইলট ছিলেন। বাবা-মাহীন মোস্তাক তালেবান আমলে চাকরিও হারিয়েছে। এখন যদি কোনো টুরিস্ট আসে, এটাই একমাত্র তার কাজ। সংসারের দায়ভার তার ঘাড়ের ওপর। মুখাসাকে কিছুদিন আগে মোস্তাক ভালোবেসে বিয়ে করেছে। এক সময়ের ধনী পরিবারের এই ছেলেটি এখন ঠিকমতো পরিবারের আহারও জোটাতে পারে না। তালেবানের ওপর তার ক্ষিপ্ততা নারীদের চাকরি ও শিক্ষা ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। তবু তাদের জীবন কাটছে। দুঃখ আর হাহাকারের মাঝেও তাদের অসীম আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা একজন আজনাবির জন্য ছিল অগণিত। এভাবেই কাবুলে আমি কয়েকদিন ধরে দারুল আলাম প্যালেস বাবর গার্ডেন, পুল ই খেশীত মসজিদ, শাহিদু শমশিরা মসজিদ, কাবুল মিউজিয়াম কুরগা লেক, টুইন ব্লু ডম শিরিন অব হজরত আলীসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থানগুলো দেখলাম। এভাবেই চলছে বিশ্বজুড়ে আমার পদচারণা...।

লেখক: ১৭৩ দেশ ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি পতাকাবাহী পরিব্রাজক

ইত্তেফাক/এসটিএম
 
unib