বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

নানা বাধায় ভাঙছে ওদের স্বপ্ন

আপডেট : ১১ মে ২০২৪, ০১:২৯

খিলক্ষেত জান-ই আলম সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. ইয়াসিন আলী জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তবে সুযোগ না পেলে ছোট একটা চাকরি করবে। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত বই থাকলেও, নেই অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ। পঞ্চম শ্রেণির পর কমতে থাকে ইংরেজি গ্রামার পড়ার সুযোগ। ইয়াসিনের মতো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা এমন স্বপ্ন নিয়ে জীবনসংগ্রাম শুরু করলেও এমন নানা প্রতিবন্ধিকতায় সবার পক্ষে সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অবশ্য বিজ্ঞজনেরা বলছেন, প্রযুক্তির এই সময়ে কোনো প্রতিবন্ধকতাই পড়ার অন্তরায় হতে পারে না, সদিচ্ছার অভাব ছাড়া। সরকার সংশ্লিষ্টদের মতে  এ খাতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবও প্রকট।

ওদের স্বপ্নগুলো বদলে যায় :দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. আলিফ আবেদিনের পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সে জানে না কীভাবে তা সম্ভব? আলিফ বলে, ‘আমাদের বই নেই, পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। হাউজ পেরেন্ট টিচার সকালে এসে পড়ান কিন্তু তিনি সব বিষয় অভিজ্ঞ নন। তাই আমি এখন ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন দেখি, তা না হতে পারলে, কোনো একটা চাকরি করব।’

মেহেদী এসএসসি রেজাল্টের অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এফএম রেডিওর অনুষ্ঠানে অংশ  নেওয়ায় তার এই সেক্টরে কাজ করার  ইচ্ছা জাগে। মেহেদী বলেন, ‘আমি আশাবাদী। আমাকে সুযোগ দিলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারব। কিন্তু ভাবি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দুই-একটা অনুষ্ঠানে ডাকলেও চাকরি দেওয়ার মতো অবস্থা হবে কি না।

ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সপ্তম সেমিস্টার পার করেও সাংবাদিক হওয়া নিয়ে সন্দিহান তফসারুল্লাহ। বলেন, সাংবাদিকতা না করতে পারলেও কমিউনিকেশনে থাকতে চাই।

ইংরেজি গ্রামার বই খুব একটা বেশি নেই। আর অঙ্কের ব্রেইল বই থাকলেও অঙ্ক করার জন্য তাদের কোনো কলাকৌশল নেই। তাই শিক্ষকরা অঙ্ক করালেও তারা অঙ্ক করে শিখতে পারে না। তবে বছরের পর বছর কীভাবে অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করলে—এমন প্রশ্ন করলে ইয়াসিন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

খিলক্ষেত জান-ই আলম সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মান্নান মুন্সি জানান, ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই স্কুলে ৭১ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করেছে। আবাসিক শিক্ষক মোসাম্মৎ সুরাইয়া খাতুন জানান, শুধু অঙ্ক নয়, বিজ্ঞানসহ সৃজনশীল পড়াগুলো পড়তেও তাদের অনেক বেগ পেতে হয়। কারণ সৃজনশীল পদ্ধতিতে ছবি দেখে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অনুভব করে যে পড়া, তা জন্ম থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কীভাবে বর্ণনা করে বোঝাব। সুরাইয়া খাতুন জানান,  এই স্কুলের একমাত্র রিসোর্স শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া নিজেই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত নন। সুরাইয়া এখানে চাকরি হওয়ার পর বিএসএড (ব্যাচেলর অফ স্পেশাল এডুকেশন) ডিগ্রি নেন। সেখানে তিনি  ব্রেইল শিক্ষাপদ্ধতি শিখেছেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সংগঠন বি-স্ক্যানের পরিচালক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ইফতেখার মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় তিনি একজন শ্রুতিলেখক নেন। তিনি বলেন, তাদের চেয়ে দুই ক্লাস নিচের শ্রুতিলেখক নেওয়ার কথা থাকলেও উঁচু ক্লাসের শ্রুতিলেখক ভাড়া করেও পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আবার বিশেষায়িত অনেক স্কুলে রিসোর্স শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত নন। আবাসিক শিক্ষক অন্যত্র থাকেন, একবেলা এসে দেখিয়ে দিয়ে যান। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা যথাযথভাবে পড়তে পারছে না। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা না করে মুঠোফোনে আসক্ত হচ্ছে। তিনি মনে করেন, শিক্ষকদের বিএসএড করা আগের মতো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আওতাধীন না রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম আরো এগিয়ে যেত ।

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ১৯ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তাদের বেশির ভাগ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। ২০২২-২৩-এ শুধু এক জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী সুযোগ পান, তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।

পুনর্বাসনেও পিছিয়ে: সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বছরে ৬৪০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য কখনোই পূরণ হয়নি। ২০১৮-১৯ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৪২৩ জন। এ সময় পুনর্বাসন করা হয় ১৩ জনকে। ২০২২-২৩ সালে শিক্ষার্থী দাঁড়ায় ৩৯৫ জন, এ সময় পুনর্বাসন করা হয়েছে ১৫ জনকে। এ ব্যাপারে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. সাব্বির ইমাম বলেন, তাদের দক্ষ জনবলের অভাব প্রকট।

প্রতিশ্রুতি আছে, নেই কার্যক্রম: অ্যাকসেস বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক আলবার্ট মো বলেন, গ্লোবাল ডিজএবিলিটি সামিট-২০২২-এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার প্রকৃত পরিবর্তনে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১১টি বিষয় উন্নয়নের কথা বলে। শিক্ষা সেখানে প্রথম অবস্থানে আছে। তবে বাজেটে বরাদ্দ না দিলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ও ইনস্টিটিউটের বিশেষ শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমান লিটু ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমি ভারতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য রসায়ন বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য উপযোগী ডিভাইস দেখেছি। অনেক দেশে এসব বিষয়ে তারা শিক্ষকতা করছে। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী শিশুদের ছেলেবেলা থেকে এটা তোমার জন্য নয় বলে দুর্বল ও নিরুত্সাহিত করা হয়। এ থেকে তারা বের হতে পারে না। আমাদের কারিকুলামে তাদের প্রবেশগম্যতা নেই। প্রযুক্তির এই সময়ে সব প্রকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে আনার জন্য বিভিন্ন রকম অ্যাপস ও ডিভাইস করার সুযোগ আছে। এজন্য সদিচ্ছা থাকতে হবে।

ইত্তেফাক/এসটিএম