বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা প্রসঙ্গ

আপডেট : ১১ মে ২০২৪, ০৫:৩৫

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত ৩০ এপ্রিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস বা রিজিওনাল ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ উপলক্ষ্যে ভার্চুয়ার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য নমনীয় মুদ্রা বিনিময় হার চালুর পরামর্শ দিয়েছে। সংস্থাটি গত প্রায় দেড় বছর ধরে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছে। তারা বলছে, বাংলাদেশ যদি বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করে, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ সামষ্টিক অর্থনীতির বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি সাধিত হবে। আইএমএফয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণ শ্রীনিবাসন বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে বাংলাদেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল ৮৩০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ঘাটতির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ যদি মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করে, তাহলে আর্থিক হিসাব ভালো হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল পেতে পারে।

আইএমএফ যে পরামর্শ দিয়েছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা ভালো একটি পরামর্শ। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে, কেননা এতে করে মুদ্রা বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা ও জোগানের চাপ এড়ানো সহজ হয়। আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখা হলে কোনো কোনো মহল এতে লাভবান হতে পারে। যেমন: যারা পণ্য আমদানি করে থাকেন, তারা লাভবান হবেন। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখা হলে তারা তুলনামূলক কম স্থানীয় মুদ্রা ব্যয় করে কাঙ্ক্ষিত পণ্য ও সেবা আমদানি করতে পারবেন। কম স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করা গেলে ভোক্তারা তুলনামূলক কম মূল্যে পণ্য পেতে পারবেন। শিল্প এবং উত্পাদনশীল খাত তুলনামূলক কম মূল্যে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে পারবেন। এতে উত্পাদনব্যয় তুলনামূলক কম হবে। কিন্তু রপ্তানিকারকগণ রপ্তানিবাবদ অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে তুলনামূলক কম স্থানীয় মুদ্রা পাবেন। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করা হলে পণ্য রপ্তানিকারকরা কিছুটা বেশি বিনিময় মূল্য পাবেন। প্রবাসী শ্রমিকরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাবেন, তাদের পরিবার সেই মুদ্রার বিনিময়ে বেশি টাকা পাবেন। আর সরকারকেও প্রণোদনা বাবদ এত অর্থ খরচ করতে হবে না। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখার ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে ক্রমবর্ধমান হারে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স দেশে পাঠান, যা অবৈধ। প্রবাসী আয়ের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ ৫ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা দিলেও কার্ব মার্কেটে এবং হুন্ডির চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে উত্সাহিত হচ্ছেন। আবার অনেকে অভিযোগ করেন যে, ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোয় ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিন্তু হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের বাসা বা কর্মক্ষেত্রেও গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বাজারভিত্তিক বিনিময় হারে পরিবারের কাছে টাকা পরিশোধ করে থাকেন। অর্থাত্ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে অর্থ পাঠানো হলে প্রেরক ও গ্রাহক কাউকেই ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয় না। তারা বাসায় বসেই লেনদেন করতে পারেন। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হলে বাজার চাহিদা ও জোগানের ওপর ভিত্তি করে মুদ্রার বিনিময় হার নিরূপিত হয়। এতে স্থানীয় মুদ্রার সঠিক মূল্য নির্ধারিত হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ও নিয়ন্ত্রণমূলক করারোপের মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্যের আমদানি নিরুত্সাহিত করা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বর্তমানে এই নীতি বাস্তবায়ন করছে। অবশ্য খাদ্য, রপ্তানিমুখী খাতের কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য, জ্বালানি ও চিকিত্সাসামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে এলসি স্বাভাবিক রয়েছে। বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। আমাদের ব্যবহূত মোট পণ্যের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তৈরি পোশাক খাতের অধিকাংশ কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং মধ্যবর্তী পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ঢালাওভাবে আমদানি কমে গেলে তৈরি পোশাক শিল্প খাতসহ অনেক খাতই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।

আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। এতে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় একধরনের অদক্ষতা তৈরি হয়েছে। প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার যখন ৮৫-৮৬ টাকা ছিল, তখনই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা প্রয়োজন ছিল। কৃত্রিমভাবে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ করে রাখার ফলে এখন হঠাত্ করেই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে, যা সামাল দেওয়া খুবই কঠিন হবে। আরো আগেই যদি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হতো, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অবস্থাও এতটা খারাপ হতো না। আর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হয়তো ৪৫-৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়ে আবার পড়ে যেত না, বরং ৩০-৩২ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল থাকত।

বিভিন্ন গবেষণা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নানা প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে মুদ্রার বিনিময় হারের ওপর চাপ পড়ছে। সীমান্তে যে সব অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য হচ্ছে, তার মূল্য মার্কিন ডলারে বা স্বর্ণে পরিশোধ করতে হয়। এতে অনেক পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যারা অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত, তারা কার্ব মার্কেট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করে থাকেন। ফলে কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও মূল্য উভয়ই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলের সঙ্গে কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ১ টাকা বা ২ টাকা পার্থক্য থাকে। কিন্তু এখন সেই পার্থক্যের পরিমাণ ১২-১৪ টাকায় উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে মুদ্রা বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখন কার্যত কার্ব মার্কেটের হাতে চলে গেছে।

বর্তমানে আমদানিকারকগণ ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে তাদের চাহিদামতো বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে পারছেন না। তাই তারা বাধ্য হয়েই কার্ব মার্কেট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছেন। কার্ব মার্কেট থেকে বেশি মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতে হচ্ছে বলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেশি পড়ছে। সেই পণ্য তারা যখন অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করছেন তখন বেশি মূল্য নির্ধারণ করছেন। ফলে নানাভাবে চেষ্টা করেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ মোট ব্যবহার্য পণ্যের তিন-চতুর্থাংশের মতো পণ্য স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত হয়। প্রশ্ন হলো, তা হলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সব পণ্যের গড়মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কেন? এর সহজ উত্তর হচ্ছে—আমাদের সাপ্লাই চেইন এখনো সঠিকভাবে কাজ করছে না। যারা পণ্য উত্পাদন করেন, তারা সংগঠিত নন। পণ্য সংরক্ষণের কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। তাই তারা পণ্য উত্পাদনের সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। মধ্যস্বত্বভোগীরা তৃণমূল পর্যায়ের উত্পাদকদের কাছে পণ্য সংগ্রহ করে শহরে এনে তা বাজারজাত করেন। উত্পাদক থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে এই পণ্য আনা-নেওয়াকালে চাঁদাবাজদের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হতে হয়। আর তাদের এই অপকর্মের দায় বহন করতে হচ্ছে ভোক্তাদের উচ্চমূল্যে পণ্য ক্রয় করে। আর লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও চাঁদাবাজরা। সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি তৃণমূল পর্যায়ের উত্পাদকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে তা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত, তাহলে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত পণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আরো অনেক আগেই বাজারভিত্তিক করা উচিত ছিল। সেই সময় মুদ্রার বিনিময় হার এখনকার চেয়ে অনেক কম ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগানও ভালো ছিল। তাই মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অধিকতর সহজ হতো। কিন্তু এখন যদি হঠাত্ করেই বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় বা বাজারভিত্তিক করা হয়, তাহলে স্থানীয় মুদ্রা টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে। এই অবস্থায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

লেখক: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)
অনুলিখন: এম এ খালেক

ইত্তেফাক/এসটিএম