বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাধ ও সাধ্য 

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৪:৫৯

আগামী অর্থবছরের শুরু থেকে মূল্যস্ফীতি পেতে শুরু করবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এটি হ্রাস পেয়ে আর্থিক বছর ২০২৫-০৬ এর শেষে ৪-৫ শতাংশে স্থিতি হবে-বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার এক সাম্প্রতিক বক্তব্যে জানিয়েছিলেন। এর পেছনে এক্সচেঞ্জ রেটের স্থিতিশীলতা এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং সরবরাহজনিত ব্যবস্থা অবদান রাখবে বলে জানানো হয়েছে এবং সে সময়ে মানুষ আগের মতো ২০ টাকা দরে আলু এবং শীতকালীন শাকসবজি সস্তায় কিনতে পারবে-এটাও বলা হয়েছে। তবে একথা অবশ্যি সত্যি যে, শুধু ব্যাংকিং খাতের সংস্কার পুরো অর্থনীতিকে ঠিক করতে পারবে না, স্টক মার্কেট, বন্ড মার্কেট, ইনস্যুরেন্স মার্কেট-সর্বক্ষেত্রেই সংস্কার দরকার এ হবে। ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ হার ১০.৮৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী মাসে আরো কিছুটা কমে আসবে এবং ক্রমান্বয়ে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতি যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল হ্রাসের ক্ষেত্রে তা বেশ শ্লথ-যা সাধারণের একটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ। 

তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধানের বক্তব্যে সাধারণ মানুষ আপাতত কিছুটা ভরসা পেলেও তারা একান্তভাবে চায় যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম তাদের সাধ্যের মধ্যে চলে আসে। আলু যা প্রান্তিক মানুষের সবচেয়ে প্রধান খাদ্য, তা এ যাবৎকালের সর্বাধিক মূল্যে বিক্রি হয়েছে। তবে ভরসার কথা তা বর্তমানে কিছুটা নাগালের মধ্য এসেছে। তেল, পেঁয়াজ সবকিছুই উর্ধ্বমুখী। সুখের বিষয়, সবজির দাম কিছুটা সাধ্যের মধ্যে। কারণ শীতের সবজি বাজারে আসতে শুরু করেছে। টিসিবির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা অচিরেই সমাধান করা প্রয়োজন। সেদিন এক রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি বলছিলেন, শীতের শাকসবজির কথা, বাজারে এর কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু দাম তাদের সাধ্যের বাইরে। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন, আগে ২০০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগ ভরে বাজার করে ফিরতে পারতেন বর্তমানে ১ হাজার টাকায়ও ব্যাগ ভরে না। জানালেন প্রতি ৫০ কেজি চাল তিনি এক মাসের জন্য কেনেন ৩৩৫০ টাকায়, যা আগে ২ হাজার টাকায় কেনা যেত। তাদের রোজগার বাড়ে তো না-ই, বরং তা কমেছে আর অসুখ-বিসুখ হলে তো নিখাদ উপোস। 

উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যরক্ষায় ঋণাত্মাক প্রভাব ফেলে। মূল্যস্ফীতির ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি হয়, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। যে কারণে স্বাস্থ্য খাতের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। যে কারণে তারা দীর্ঘদিন হেলথ কেয়ারের বিষয়টিকে চেপে রেখে মূলত কঠিন সমস্যায় পড়তে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ইনডেক্সের প্রচলন নেই, তবে ইউএস ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিস বা বিইএ পার্সোনাল কনজাম্পসন এক্সপেন্ডিচার প্রাইস ইন্ডেক্স বের করে- যা কনজিউমার স্পেন্ডিং ফর হেলথকেয়ার বিবেচনা করে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো ইনডেক্স নেই, তবে করা হলে এ ব্যাপারে জানা যেতে পারে। 

দীর্ঘদিন থেকে রয়ে যাওয়া এ উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এর কারণগুলো একাধিক বার আলোচিত হয়েছে। ৮ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন গভর্নরের দায়িত্বে অনেকটা স্বাধীনভাবেই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১১ বার পলিসি রেট বাড়ানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতির উচ্চমাত্রা কমানোর সবচেয়ে উত্তম ওষুধ বলে ধরা হয়। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কিছুতেই কমছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ মেডিসিন ভালো ফলাফল দিলেও বাংলাদেশে এ যাবৎ এর কার্যকরী সফলতা দেখা যায়নি। সাধারণভাবে মূল্যস্ফীতি হ্রাসের জন্য মনিটারি, ফিস্ক্যাল এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের সমন্বয়ের দরকার হয়। মনিটারি পলিসি সংকোচনমূলক এবং ফিস্ক্যাল পলিসি দেরিতে হলেও সরকারি খরচ সংকোচনমূলকই বলা যায়। বাজারে সব পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি, তাও বলা যায় না। তবে ডিমের দামের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে এগুলোর দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করেলেও বাজারে এর প্রভাব দেখা যায়নি। আমদানি শুল্ক কমালেই যে নিত্যপ্রয়োজনীয়ও জিনিসের দাম কমবে তা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। 

আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খল সঠিক রাখতে যে দুটো মূল বিষয়-উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান, স্টোরেজ ব্যবস্থাপনা-দুটোই একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান অনেকটা অনুমানভিত্তিক, কৃষকের নিজস্ব স্টোরেজ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সরকারি গুদাম যে পরিমাণে দরকার, তা নেই। নেই পরিপূর্ণ মনিটরিং। ব্যবস্থা-যা থেকে আগেভাগেই কোন খাদ্য কোন সময়ে ঘাটতি পড়বে-তা জানা যাবে। খাদ্যশস্য আমদানির মধ্য সরকার সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় চাল এবং গম। 

সরকার বিভিন্ন সময়ে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য কমিটি গঠন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ট্যারিফ কমিশনকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেও তা তেমনভাবে কার্যকরী হয়নি। এ ব্যাপারে টিসিবিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, মজুত এবং সরবরাহব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বলা হয়ে থাকে, বিগত সরকার সম্পদ না বাড়িয়ে টাকা ছাপিয়ে দায়দেনা শোধ করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিরসন করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, নেট ফরেইন অ্যাসেট যা জুন ২০২০-এ ছিল ২.৮৬ লাখ কোটি টাকা, তা জুন ২০২৪-এ এসে দাঁড়িয়েছে ২.৪৭ কোটি টাকায়। অন্যদিকে ডমেস্টিক অ্যাসেট বেড়েছে ১.৬৭ লাখ কোটি টাকা। এ সম্পদ রিয়েল অ্যাসেট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়নি অর্থাৎ মুদ্রা ছাপানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু তা উৎপাদন বা রপ্তানির কাঁচামাল ক্রয়ে ব্যবহার করা হয়নি, যা মূল্যস্ফীতি উসকে দিতে সাহায্য করেছে। অন্য দিকে নন-পারফরমিং লোনের পরিমাণ বেড়েছে, ২০২২-এ যা ছিল মোট ঋণের ১২.৯ শতাংশ, ২০২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ২৩.৫ শতাংশ (অ্যানুয়াল রিপোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংক)। সাধারণত ক্ষুদ্র উদোক্তারা ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ পায় না, বড় উদ্যেক্তারাই ঋণখেলাপি হয়েছে, এদের মধ্য কতটুকু ইছাকৃত খেলাপি আর কতটুকু প্রকৃত কারণে খেলাপি-তা নির্ধারণ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব।

একই সঙ্গে বেড়েছে ব্রড মানির পরিমাণ, যেমন ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল ৯.৪ শতাংশ, ২০২৩ সালে এসে তার পরিমাণ হয়েছে ১০.৫ শতাংশ। অর্থনীতিতে দুই ধরনের মানি থাকে একটি হলো ব্রড মানি, অন্যটি হলো ন্যারো মানি। ন্যারো মানি হলো কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক প্লাস ডিমান্ড ডিপোজিট, অন্য দিকে ব্রড মানি হলো কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক গ্লাস ডিমান্ড ডিপোজিট প্লাস টাইম ডিপোজিট। ব্রড মনি বেড়ে যাওয়া ইনফ্রেসনের আর একটি কারণ হতে পারে, কারণ এর অর্থ হলো মানুষের হাতে অর্থ আছে কিন্তু বাজারে দরকারি জিনিস নেই অর্থাৎ সরবরাহ ঘাটতির কারণে মুদ্রাস্ফীতি। 

সরকার অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের শুল্ক হ্রাস করেছে, যেমন-ডিম, পেঁয়াজ, চাল, তেলের আমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু দরকার অনুযায়ী পণ্য সময়মতো আমদানি করা যায়নি, এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। যেমন-রপ্তানিকারক দেশের আমদানিতে অনীহা, যার উদাহরণ আমরা অতীতে দেখাছি। রপ্তানিকারী দেশে মূল্যের হার, যা আমদানিকারকের জন্য সুবিধাজনক হয়নি, আমদানির জন্য নিয়মকানুন, স্ট্যান্ডার্ড, কমপ্লায়েন্স ইত্যাদি কাজেই আমদানি করা হবে বললেই সঙ্গে সঙ্গে আমদানি করে ঘাটতি মেটানো অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। অন্যদিকে চাকরি এবং উচ্চ মজুরি পরিবারের আয় বাড়ায় এবং ভোক্তাদের ব্যয় বৃদ্ধি করে, সামগ্রিক চাহিদা আরো বৃদ্ধি করে এবং সংস্থাগুলোর জন্য তাদের পণ্য ও পরিষেবার দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে। যখন এটি একটি বৃহৎসংখ্যক ব্যবসা এবং সেক্টর জুড়ে ঘটে, তখন এটি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। 

বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঠিক কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি আছে বলে মনে হয়নি, খরে থরে সাজানো রয়েছে সব পণ্য। শুধু কেনা যাবে না উচ্চমূল্যের কারণে। অন্য দিকে, দাম কমেছে বলা হয়, তাও বেশ মজার। ডিমের দাম ১৮০ টাকা হয়ে যাওয়ার পর, ১৬০ টাকা হলেই তা দাম কমেছে বলে ধরা হয়, কিন্তু সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এলো কি না-তা দেখার কেউ নেই। অথচ ডিমের দাম হওয়া উচিত বেশি হলে ১২০ টাকা, যা কিছুদিন আগেও ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য সঠিক হোক আমরা সে ভরসায় থাকতে চাই।

লেখক: 'বিল্ড'-এর নির্বাহী পরিচালক

ইত্তেফাক/এনএন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

 
unib