রোববার, ১৬ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

ইরানের ভেতর থেকেই রাইসিকে হত্যা?

আপডেট : ২৪ মে ২০২৪, ১৫:৩২

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ার পর দেশটির রাষ্ট্রীয় মিডিয়া যে খবর পরিবেশন করেছে তাতে অসঙ্গতি দেখা গিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলোতে অসংখ্য পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যা জনগণকে বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি প্রদত্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করেছে।

কীভাবে এবং কখন ঘটনাস্থল সনাক্ত করা হয়েছিল তার বিভিন্ন বিবরণসহ প্রাথমিক খবরে বেশ অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে।

পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রকাশ করা হয়েছিল কিনা তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এটি জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের জন্য তাদের প্রস্তুত করার একটি কৌশল হতে পারে।

ঘটনাটি অস্বীকার করে প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডসের (আইআরজিসি) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফারস নিউজ। শুরুতে সংবাদ মাধ্যমটির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছিল, ‘প্রেসিডেন্ট রাইসি ও তার সফর সঙ্গীদের বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার শিকার’ শিরোনামে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে খবর ছড়ানো হচ্ছে তা ভিত্তিহীন।

ফারস নিউজ আরও দাবি করেছে, পূর্ব আজারবাইজানের উত্তরাঞ্চলে ঘন কুয়াশার কারণে রাষ্ট্রপতি রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি জরুরি অবতরণ করেছে এবং গাড়িতে করে তাদের যাত্রা চলছে।

পরে অবশ্য সংবাদ মাধ্যমটি তার প্রাথমিক বিবৃতি প্রত্যাহার করে লিখেছে, রাইসির সফরসঙ্গীদের বহনকারী একটি হেলিকপ্টার ‘হার্ড ল্যান্ডিং বা বিপজ্জনক অবতরণ’ করেছে।

রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী আইআরআইবিকে দেওয়া লাইভ সাক্ষাৎকারে ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও একই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, বোর্ডে থাকা কিছু ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। উদ্ধারকারীরা  দুর্ঘটনাস্থলের দিকে যাচ্ছে।

আইআরআইবিতে ইরানের উপ-প্রেসিডেন্ট মোহসেন মনসুরি বলেছেন, একই হেলিকপ্টারে রাষ্ট্রপতির সফরসঙ্গীর দুই সদস্য সফলভাবে উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এই যোগাযোগের কারণে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বাতাস ততটা তীব্র ছিল না যতটা প্রাথমিকভাবে আশঙ্কা করা হয়েছিল।

তার এই বর্ণনা আরও জটিল হয়ে যায় যখন রাষ্ট্রপতির কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তাবরিজের জুমার নামাজের ইমাম মোহাম্মদ আলী আল-হাশেম রাইসির সঙ্গে ছিলেন। তিনি কথিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন। এমনকি তিনি উদ্ধারকারীদেরও শুনতে পাচ্ছেন।

এই দাবির পর প্রশ্ন আসে, তাহলে নিশ্চয়ই উদ্ধারকারীরা কার্যকরী জিপিএসের অভাবে দুর্ঘটনাস্থল সনাক্ত করতে পারেনি। আল-হাশেম যদি ঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারতেন তাহলে উদ্ধারকারীরা কেনো জিপিএস ট্র্যাক করে ঘটনাস্থল সনাক্ত করতে পারেনি।

পূর্ব আজারবাইজানের ডেপুটি গভর্নরও নিশ্চিত করেছেন, বহরে তিনটি হেলিকপ্টার ছিল। দুটি নিরাপদে অবতরণ করেছে এবং একটি বিধ্বস্ত হয়েছে।

দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার বিভ্রান্তি

প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় দুই ঘণ্টা পর আধা সরকারি বার্তা সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, একটি মানচিত্রের সাহায্যে তারা প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার আনুমানিক অবস্থান সনাক্ত করতে পেরেছে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া ও প্রতিকূল ভূখণ্ডের কারণে উদ্ধারকারীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছে না।

প্রাথমিকভাবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইআরআইবির মতো রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বৈরি আবহওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে ক্রমাগত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় বহরে থাকা বাকি দুটি হেলিকপ্টারের কথা ধীরে ধীরে বাদ দেওয়া হয়।

এই বর্ণনা থেকে প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি বৈরি আবহাওয়ার জন্য দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে তবে বাকি দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে গন্তব্যে গেলো কীভাবে। এরপরই রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে এ বিষয়ে নজর না দিয়ে বরং বৈরি আবহাওয়ার ওপর বেশি জোর দেওয়া হতে থাকে।

অনুসন্ধান কাজ চলাকালীন সুপ্রিম লিডারের মন্তব্য

রাইসির মৃত্যু খবর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি জনসমক্ষে বিবৃতি দেন।

রাইসি সম্পর্কে এবং প্রেসিডেন্ট ছাড়া দেশের ভবিষ্যত কেমন হবে তা নিয়ে খামেনির মন্তব্য এখানে লক্ষ্যণীয়। তিনি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালিত হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে ড্রোন হামলায় যখন আইআরজিসি কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি নিহত হয়েছিলেন তখন খামেনি কাঁদতে কাঁদতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিন্তু রাইসির মৃত্যুর খবর ঘোষণার সময় তার কণ্ঠে সেরকম কোনো আবেগ দেখা যায়নি।

ইরান ও তুরস্কের বিরোধপূর্ণ দাবি

বিধ্বস্তের খবর পাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর তাসনিমের মতো বার্তা সংগুলোস্থা ধ্বংসাবশেষের সঠিক অবস্থান পাওয়ার দাবি করেছে। তবে এসব দাবির সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের বিবৃতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলেছিল, অনুমানের ভিত্তিতে ঘটনাস্থল খোঁজা হচ্ছে। তবে তেমন কোনো সাফল্য পাওয়া যায়নি।

পূর্ব আজারবাইজানের ক্যালেবার এমপি হোসেইন হাতামি হেলিকপ্টারের ভেতরে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের দাবি অস্বীকার করার পর ঘটনা আরও বিভ্রান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। হাতামি বলেছিলেন, রাইসির হেলিকপ্টারে থাকা কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। পরিস্থিতি যেমন ছিল তাতে এভাবে যোগাযোগের চিন্তা করাও অবাস্তব।

১৫ ঘণ্টার বেশি সময় পরে অনুসন্ধান শেষ হয় এবং ইরানি কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রস্তাব সত্ত্বেও ধ্বংসাবশেষ সনাক্তকরণে বিদেশি সহায়তা থাকার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে ইরান।

ইরানি উদ্ধারকারীরা প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনাস্থল খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিল। এতে তুরস্ক ও রাশিয়াকে সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপরই তুরস্ক একটি নাইট ভিশন ড্রোন মোতায়েন করে ইরানকে সহায়তা করে।

পরস্পরবিরোধী দাবি

তুরস্কের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রেড ক্রিসেন্টের প্রধান পীর হোসেন কোলিভান্দ এবং আইআরজিসি কমান্ডার আসগর আব্বাসঝোলিসহ ইরানের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, তুর্কি ড্রোনের পাঠানো তথ্যে ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত ইরানি বাহিনীই ঘটনাস্থল সনাক্ত করেছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আইআরআইবিতেও একই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদুলুতে তুর্কি ড্রোনের উদ্ধার কাজ লাইভ সম্প্রচার করা হয়েছে। আর ইরানের মিডিয়া এর বিপরীত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট ছিল।

স্থানীয় উদ্ধারকারীরা ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার মুহূর্তটি দেখিয়েছে। প্রচারিত একটি ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, স্থানীয় মোটরসাইকেল চালকরা প্রথমে ঘটনাস্থল খুঁজে পান। তারাই ঘটনাস্থল সনাক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত এক সাক্ষাত্কারে স্থানীয়রা দাবি করেন, হেলিকপ্টারটি ‘সম্পূর্ণ বিস্ফোরিত হয়েছে এবং সবকিছু পুড়ে গেছে।’

এখানে ইরানি কর্মকর্তা ও বিদেশি সূত্রের মধ্যে বিরোধপূর্ণ বিবরণ দুর্ঘটনার অনুসন্ধানের প্রকৃত সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

উদ্ধারকৃত লাশ নিয়ে বিভ্রান্তি

উদ্ধার হওয়া লাশের অবস্থা নিয়েও পরস্পরবিরোধী খবর পরিবেশন করা হয়েছে। ইরানের ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান মোহাম্মদ হাসান নামি বলেছেন, হেলিকপ্টারে থাকা সবাই পুড়ে গেছেন। তবে এখনো তাদের সনাক্ত করা যাচ্ছে। বিপরীতে আইআরজিসি কমান্ডার আসগর আব্বাসঝোলি দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপতি রাইসির দেহ পুড়ে যায়নি।

এই পরস্পর বিরোধী বিবৃতি ঘটনাটিকে ঘিরে বিভ্রান্তি এবং অনিশ্চয়তাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এতে দুর্ঘটনার পরিস্থিতি এবং প্রতিক্রিয়া প্রচেষ্টা সম্পর্কেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আইআরজিসির মিডিয়া কৌশল

রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো প্রায়ই উল্লেখযোগ্য ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। কারণ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে এই ধরনের তথ্যের অ্যাক্সেস নেই। এই কৌশলটির লক্ষ্য হলো জনগণকে ধীরে ধীরে সম্ভাব্য বড় কোনো খবরের জন্য প্রস্তুত করা।

পরস্পরবিরোধী বা প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে আইআরজিসি অধিভুক্ত মিডিয়া জনসাধারণকে বড় খবর সহজে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত করেছে। এতে সামাজিকভাবে যে প্রতিক্রিয়া আসার কথা ছিল তা ঠেকানো গেছে।

এছাড়াও, তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করাও ছিল আইআরজিসির কৌশল। তাতে নিশ্চিত করা হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য মতোই সংবাদগুলো পরিবেশন করা হয়েছে এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া হ্রাস করা গেছে।

কেউ কেউ আবার বলছেন একেক রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করা দেশটির গণমাধ্যমের বিশৃঙ্খলার বহিঃপ্রকাশ। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষকই তা মানতে নারাজ। অনেকের মতে এটি সরকার পরিচালনার একটি কৌশল মাত্র। বিরোধর্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করা জনগণের সামলোচনা নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি কৌশল।

এই ধরনের সফরের স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকলে তিনটি হেলিকপ্টার থাকে। একটি থাকে সামনে, অন্যটি মাঝখানে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য এবং তৃতীয়টি পেছন থেকে সহায়তার জন্য। তবে শেষ মুহূর্তে হেলিকপ্টারের পজিশনে অদল বদল করা হয় যা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ছিল না।

ফ্লাইটের সময় রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারের পাইলট বমি বমি ভাব অনুভব করেছিলেন। অন্য হেলিকপ্টারে যারা ছিল তারা শেষ পর্যন্ত বিধ্বস্ত হওয়ার আগে মূল হেলিকপ্টার থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখেছিলেন বলে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন।

গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরানোর ক্ষেত্রে ইরানের ইতিহাস এবং পরস্পর বিরোধী খবর পরিবেশন স্বাভাবিক অর্থেই রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জল্পনা তৈরি করেছে।

অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ইরানের অতীত ইতিহাস এবং প্রচারিত বিরোধপূর্ণ কর্মকাণ্ড বিবেচনা করলে এখানে কর্তৃপক্ষের ভুল হয়েছে এমনটা জোর দিয়েও বলা যাবে না। এই অনিশ্চয়তা সরকারের পক্ষ থেকে ইচ্ছাকৃত কিনা তা দেখার বাকি আছে।

এছাড়া দেশটির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি, রাইসির হেলিকপ্টার কি ধরণের দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেইসঙ্গে দেশটির রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোতে পরস্পরবিরোধী সংবাদ রাইসির হেলিকপ্টারের দুর্ঘটনায় প্রকৃত কারণ নিয়ে জল্পনা বাড়ছে।

ইত্তেফাক/এসএটি
 
unib