বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

চম্পট টু চাঁপাই!

আপডেট : ১২ জুলাই ২০২৪, ০৩:৩৫

ছোটবেলায় ‘জার্নি বাই ট্রেন’ প্যারাগ্রাফে আমরা সবাই লিখেছিলাম, ‘জানালার বাইরে যতদূর চোখ যায় শুধু ধানখেত আর ধানখেত।’ তেমনভাবে যদি ‘জার্নি বাই মাহেন্দ্রা’ নামে একটা প্যারাগ্রাফ লেখা যেত তবে এই লাইনটা সামান্য পরিবর্তন করে লিখতে হতো, ‘বাইরে যতদূর চোখ যায়, শুধু আমগাছ আর আমগাছ।’ একটুও বাড়িয়ে বলছি না, হাতেগোনা কয়েকটি স্থান বাদে পুরো পথটার দু-ধারেই সারিসারি করে আমগাছ লাগানো। গাছগুলোর প্রতিটি ডালপালা সেজে উঠেছে আমে। খানিকক্ষণ চোখ বুজে থাকলে আমের তাজা ঘ্রাণে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায়।

রাজশাহী শহর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের যাত্রাটা এমনই। শিবগঞ্জেই প্রাচীন বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্প-সংস্কৃতির সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট সোনা মসজিদ। রাস্তার একেবারে কিনার ঘেঁষে মসজিদটির অবস্থান। সুলতান আলা-উদ-দীন শাহের শাসনামলে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন ওয়ালি মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ছোট সোনা মসজিদের আসল নাম হলো ‘গৌড়ের রত্ন’। কিন্তু তত্কালীন গৌড়ে সুলতান নুসরত শাহ আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আকারে গৌড়ের রত্নের তুলনায় বড়।  ছোট সোনা মসজিদ যে শুধুমাত্র প্রাচীন বাংলার ইতিহাসই ধারণ করে আছে তা কিন্তু নয়, মসজিদ প্রাঙ্গণের দক্ষিণ-পূর্বদিকে তাকালে চোখে পড়ে দুটি সমাধি। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হক।

কাছের একটি হোটেলে দুপুরের খাবার সেরে আবার উঠে পড়লাম মাহেন্দ্রতে। পরবর্তী গন্তব্যস্থল ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার। প্রায় মিনিট ১৫ পর পৌঁছে গেলাম বর্ডারে।

এরপরের গন্তব্য চামচিকা মসজিদে। বর্ডার থেকে চামচিকা মসজিদে যেতে সময় লাগল প্রায় মিনিট পাঁচেকের মতো। এখানে একটা কথা না বললেই নয়—মসজিদটির নাম খানিকটা বিদঘুটে শোনালেও মসজিদটি দেখতে অত্যন্ত চমত্কার। ধারণা করা হয় ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে কোনো এক রাজবিবি এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। যে কারণে এটি ‘রাজবিবি মসজিদ’ নামেও পরিচিত। তবে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে ‘চামচিকা’ নামকরণের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে হতাশ হতে হলো। কেউই সেভাবে উত্তর দিতে পারলেন না। তবে কারো কারো ভাষ্যমতে, আগে এই মসজিদটি ছিল চামচিকাদের অভয়ারণ্য। সেখান থেকেই স্থানীয়দের মুখে মুখে এটি প্রচলিত হয় চামচিকা মসজিদ নামে।

তবে ইতিহাস দেখলে খোঁজ মেলে নামকরণের পেছনের আরেকটি ব্যাখ্যা। মসজিদটি দেখতে অনেকটা মালদহের চামকাটি মসজিদের মতোই। সেখান থেকেই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছিল চামকাটি মসজিদ, যা পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় চামচিকা মসজিদে। যারা এরইমধ্যে নামকরণের গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছেন তাদের উদ্দেশে জানিয়ে রাখি মসজিদটির আরেকটি সুন্দর নাম আছে। তা হলো ‘খনিয়াদিঘী মসজিদ’।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল তোহাখানা। এটিও শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন বাংলার একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। চামচিকা মসজিদ থেকে মাহেন্দ্র করে তোহাখানায় যেতে সময় লাগল ১৫ মিনিটের মতো। তোহাখানা মূলত তিনতলাবিশিষ্ট একটি রাজপ্রাসাদ। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বাংলার সুবেদার থাকাকালে তার মুর্শিদ হজরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতউল্লাহর প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করেছিলেন এই তাপনিয়ন্ত্রিত ইমারত।

তীব্র রোদের কারণে একটু পরপরই ক্লান্তি এসে ভিড় করছিল দেহে। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সবাই তোহাখানাসংলগ্ন দিঘির পাড়ে গিয়ে বসলাম। খানিকক্ষণ পর দেখি কোথা থেকে তিনটি শিশু এসে দিঘির পাড়ে দাঁড়াল। তারা উচ্ছ্বসিত, কিন্তু খানিকটা সন্দিহান চোখে অপলক তাকিয়ে আছে দিঘির পানির দিকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাম, অথচ বিখ্যাত আদি চমচম না খেয়ে ফিরে যাব, তা কী হয়? আকারভেদে এখানে দু-রকমের চমচম পাওয়া যায়, ছোট ও বড়। তবে স্বাদে কোনো ভিন্নতা নেই। টেবিলে চমচম দিতে দিতে ওয়েটার জানালেন, বড় আকারের ৬টি চমচমের ওজন হয় ১ কেজি অর্থাৎ একেকটির ওজন প্রায় ১৬৬ গ্রাম। চমচমের সঙ্গে আরো দুই প্রকারের মিষ্টি পাওয়া যায়, লালমোহন ও দম। তিন রকমের মিষ্টির স্বাদ মুখে লাগিয়ে আমরা রওনা হলাম জীবনের গত্বাঁধা রুটিনের উদ্দেশে!

ইত্তেফাক/এসটিএম
 
unib