গরমে পুড়ছে প্যারিস, উত্তপ্ত গরমের মধ্যেই অসীম ধৈর্য নিয়ে অলিম্পিক গেমস আর্চারি উপভোগ করছিল ফ্রান্সের দর্শক। অনেকের হাতে আইসক্রিম, কোমল পানীয়, বাচ্চারা কাপ আইসক্রিম নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছাতার নিচে বসে আছে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে দর্শক বেরিয়ে গ্যালারির নিচে চলে যাচ্ছেন ছায়ার খোঁজে। তরুণ-তরুণীরা গরম সইতে না পেরে গায়ে পানি ঢালছেন। অলিম্পিক গেমসের আর্চারির কালকের ছবিটা ছিল এরকম।
একেকটা দেশ আসছে তীর-ধনুকের লড়াই করছে, জয়-পরাজয় নিয়ে বাড়ি ফিরছেন আর্চাররা। প্যারিসের ইনভেলিদসে অস্থায়ীভাবে আর্চারির ভেন্যু করা হয়েছে। স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে নির্মিত গ্যালারি, হুইল চেয়ারে আসা দর্শকের জন্য পিচঢালা পথ গিয়ে মিশেছে গ্যালারিতে, মিডিয়া বক্স, মিডিয়া সেন্টার। দুই পাশে পাখির ডানার মতো করে চার তলা উঁচু অস্থায়ী গ্যালারি করা হয়েছে।
প্যারিসের ইনভেলিদসে দুপুরেই শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের অভিযান। আশঙ্কা যা ছিল তা-ই হয়েছে। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় হয়ে গেছে বাংলাদেশের আর্চার সাগর ইসলামের। ইতালির আর্চারের বিপক্ষে ৬-০ সেটে হেরে বিদায় নিলেন অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী সাগর।
এবারের অলিম্পিক গেমসে কোয়ালিফাই করে খেলতে আসা একমাত্র ক্রীড়াবিদ সাগর ইসলাম। বাংলাদেশের রাজশাহীর ছেলে সাগর ইসলাম যখন খেলাটা শেষ করেই বের হচ্ছিলেন, জার্মানি কোচ মার্টিন ফ্রেডরিক তার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন। চোখ-মুখে হতাশার ছাপ। কথা বলতে গেলে গেমেসের স্বেচ্ছাসেবকরা বাধা দেন, এখানে কথা বলা যাবে না, ওখানে যান।
সাগর এবার তার কোচ মার্টিন ফেড্রিরিক এদিক-সেদিক ঘুরলেন। বিরক্তির ছাপ নেই। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন সাগর এবং কোচ মার্টিন। পাঁচ সেটের খেলা। প্রথম তিন সেট পরপর হেরে যান সাগর। প্রথম ধাক্কাতেই গুঁড়িয়ে যান সাগর। যে কারণে পরের রাউন্ড খেলা হয়নি। সংবাদমাধ্যমকে সরাসরি বলে দিলেন সাগর, 'আমি নতুন এসেছি। প্রথমবার খেললাম। অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে। ভবিষ্যতে ভালো করতে পারব। কেউ তো হারতে চায় না। সবাই জিততে চায়। আমিও তাই চেয়েছিলাম। আরেকটু ভালো করতে পারতাম।'
খেলার কোন জায়গাটায় ভুল হয়েছিল? সাগর বললেন, 'খেলাটার একটা কনসেন্ট আছে, ওটা আমি কুইক ধরতে পারিনি।' সাগর বলছেন, 'এখানে আমার হারানোর কিছু নেই। আমি নতুন, সবে মাত্র আমার শুরু হয়। ইতালিয়ান আর্চার বলেও আমি চাপ নিইনি।' দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সাগরের প্রতিপক্ষ ছিল গত টোকিও অলিম্পিক গেমসের রৌপ্য পদক জয়ী মাওরো নেপোলি। অনেক বেশি অভিজ্ঞ। ইতালিয়ান এই আর্চার খুব সহেজই টোকিও অলিম্পিকে রৌপ্য পদক জয় করেননি, তার আগে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এত দূর এসেছিলেন।
সেই তুলনায় সাগর মাত্রই শুরু করেছেন। ১৮ বছরের তরুণ আর্চার সাগর এবারই প্রথমবার অলিম্পিক গেমসের মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গেমসে খেলছেন। অলিম্পিক গেমসের পরিবেশও তার চেনা নেই, জানা নেই। এক সপ্তাহ আগে অলিম্পিক গেমসের বড় পরিবেশ দেখলেন। কয়েক হাজার দর্শক খেলা দেখলেন। ঢাকায় যখন খেলা হয়, তখন দর্শক থাকেন না। কিন্তু অলিম্পিক গেমসের আর্চারিতে কয়েক হাজার দর্শক।
এমন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে খেলতে হলে অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তবে আর্চার সাগর এখনই মনোবল হারাতে চান না। এখন তার কাছে মনে হচ্ছে আর্চারির দুনিয়াটা অনেক বড়। অনেক দূর যাওয়ার সুযোগ আছে। আমি এখানে হারিনি। এখানে শিখেছি। আর কথা হচ্ছে, আমি তো মাত্রই শুরু করেছি। ১৮ বছর বয়স। তার সামনে এনে ইতালিয়ান আর্চার মাউরো নাসপোলি প্রথম তিন শটে ১০, ১০, ১০ করে ৩০ স্কোর করেছেন। যেখানে সাগরের স্কোর ছিল ৮, ৯, ১০। দ্বিতীয় সেটে মাউরো প্রথম সেটের মতো ভালো স্কোর করতে পারেননি ইতালিয়ান আর্চার।
তীর-ধনুকের খেলাটা অনেকটাই নির্ভর করে বাতাসের ওপর। ছুঁড়ে দেওয়া তীর বাতাসে ভেসে গিয়ে টার্গেট পয়েন্টে বিদ্ধ হয়। ভেসে যাওয়ার সময় বাতাসের হেরফের হলে নিশানা ঠিক থাকে না। ইতালিয়ান আর্চার সেখানেই পিছিয়ে গিয়েছিলেন। স্কোর করেছিলেন ৮. ৯। আর সাগর স্কোর করেছিলেন ৭ এবং ১০। একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। তৃতীয় শটে ১০ স্কোর করে মুন্সিয়ানা দেখান ইতালির আর্চার, অন্যদিকে সাগরের স্কোর ছিল ৯। তৃতীয় সেটে সাগর আর পারেননি। তিনি স্কোর করেন ৮, ৯, ৮। ইতালিয়ান আরচারের স্কোর ছিল ৯, ৯, ১০।
দর্শক করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায় মাউরো নাসপোলিকে। সাগর বেরিয়ে আসেন। কোচ এবং সাগর কথা বলেন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। তারপরই সাগর তার কোচকে জড়িয়ে ধরে সরি বলেন। সাগরের পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দেন কোচ ফ্রেডরিক। দুজনেই তীর-ধনুক হাতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, একটু একটু করে পেছনেও তাকাচ্ছিলেন সাগর। এই স্মৃতি মনে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। চোখ পড়ছে গেমেসের জন্য অস্থায়ী নির্মাণ, আর্চারির স্থাপনার দিকে।