গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এই দাবিটি দৃঢ় আইনি রূপ নেয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ পাওয়া গেছে। হত্যা, নির্যাতন থেকে শুরু করে গুম পর্যন্ত- বিভিন্ন অপরাধের জন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করে, নয়াদিল্লির আইনগত পদক্ষেপ কী হবে?
১৯৬২ সালে ভারতের প্রত্যর্পণ আইন ছাড়াও ২০১৩ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল। ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইনের ১২(২) ধারায় ভারতের প্রত্যর্পণ আইনের সংশ্লিষ্ট অংশগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানাতে ২০১৩ সালের চুক্তির ওপর নির্ভর করতে পারে বাংলাদেশ। চুক্তির ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতকে শুধু তাদের ভূখণ্ডে প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ (ভারতীয় ও বাংলাদেশের আইনে কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ডের শাস্তিযোগ্য) অন্য দেশের ভূখণ্ডে প্রত্যর্পণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে এটি সেই ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও হয়, যাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের আদালতে এখনো দোষী প্রমাণিত না হলেও হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা যাবে। তার বিরুদ্ধে এসব অপরাধের অভিযোগ আনাই ভারত থেকে তার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়া ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির ১০(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রত্যর্পণ চাওয়ার জন্য অনুরোধকারী রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা উপস্থাপন করাই যথেষ্ট। সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ অনুরোধকৃত রাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করার দরকার নেই। এটি ২০১৬ সালে চুক্তিতে করা একটি সংশোধনী। মূল চুক্তিতে অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ প্রমাণগুলো অনুরোধকৃত রাষ্ট্রের সাথে শেয়ার করার প্রয়োজন ছিল। অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণ ত্বরান্বিত করতে ২০১৬ সালে প্রমাণগুলো শেয়ার করে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাতিল করা হয়েছিল।
তাই বাংলাদেশ এ ধরনের অনুরোধ করলে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণে ভারতের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অপরাধটি রাজনৈতিক চরিত্রের হলে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইনের ৩১(১) ধারায়ও এই রাজনৈতিক ব্যতিক্রমের বিধান রয়েছে। তাহলে হাসিনার প্রত্যর্পণ ঠেকাতে ভারত কি এসব ধারার ওপর নির্ভর করতে পারবে? এর উত্তর 'না'। কারণ চুক্তির ৬(২) অনুচ্ছেদে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা ও অন্যান্য অপরাধকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত ৭ নং অনুচ্ছেদে অনুরোধ করা রাষ্ট্রকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে- যদি সেই ব্যক্তির অপরাধের জন্য অনুরোধ করা রাষ্ট্রের আদালতে বিচার করা হয়। এই বিধানটিও হাসিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ ভারতের আদালতে হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তা দেখানোর মতো কিছুই নেই।
তৃতীয়ত, চুক্তির ৮(১)(এ)(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা যাবে না যদি তিনি অনুরোধকৃত রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে সন্তুষ্ট করেন যে, সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে প্রত্যর্পণ করা অন্যায় বা নিপীড়নমূলক হবে। সন্তুষ্ট করতে হবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ 'ন্যায়বিচারের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে' করা হয়নি। একই নীতি ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইনের ২৯ ধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। হাসিনার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হতে পারে।
ভারতের হাতে আরেকটি আইনি বিকল্প আছে। চুক্তির ২১(৩) অনুচ্ছেদে নোটিশ দিয়ে যে কোনো সময় এই চুক্তি বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ভারতকে। নোটিশের তারিখের ছয় মাস পর থেকে চুক্তির কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ভারত এই বিকল্পটি ব্যবহার করবে কিনা তা নির্ভর করবে নয়াদিল্লির বন্ধু শেখ হাসিনাকে ভারত কতটা মূল্য দেয় তার উপর। যদিও নয়াদিল্লি হাসিনার পাশে দাঁড়াতে চায়, তবে একতরফাভাবে চুক্তিটি বাতিল করা ঢাকার সাথে তার সম্পর্ককে তিক্ত করতে পারে।
(ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমসে লেখা ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের অধ্যাপক প্রভাষ রঞ্জনের মতামত)