দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ- উপাচার্যসহ প্রায় শতাধিক প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক পদত্যাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রশাসনিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার না থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম কার্যত বন্ধ রয়েছে।
ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হলেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম প্রধান এই বিদ্যাপীঠে এখনো উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কে হবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য নিয়োগের আলোচনায় এগিয়ে আছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩ জন শিক্ষক।
আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান গ্রেড-১ অধ্যাপক ড. মো. হারুনর রশিদ খান। তিনি জাতীয় ও অন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে ১৩০টির অধিক আর্টিকেল প্রকাশ করেন যেগুলোর সাইটেশন সংখ্যা ১১ হাজারের ওপরে। তিনি অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স, সেমিনার ও ওয়ার্কশপে অংশ নেন।
দীর্ঘ ৩২ বছরের শিক্ষকতা ও গবেষণা জীবনে ড. হারুনর রশিদ নোবলেজয়ী গবেষকদের সঙ্গেও কাজ করেন। ২৬ মে ২০১২ তারিখে 'দৈনিক আমার দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তার লেখা 'সাদা ওয়াইন ও টেকসই গণতন্ত্র' কলামটি সেসময় ড. ইউনূসের শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া ফেলে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরে জাপান সরকারের মনবুশো বৃত্তিতে সাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি এবং টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে প্রথম ও সাগা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করেন। তিনি সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি, হলের প্রভোস্ট, ডিন, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রধান ও রিসার্চ সেলের ডিরেক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন।
ড. হারুনর রশীদ সৌদি আরবের কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সাল থেকে অধ্যাপক হিসেবে লিয়েনে পাঁচ বছর কর্মরত ছিলেন। কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ এটোমিক এনার্জি কমিশন ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের মধ্যে চলমান যৌথ গবেষণা দলের নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। গবেষক হিসেবে তিনি জাপানের হাই এনার্জি এক্সেলেটর রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (কেইকে) বেল কোলাবরেটর এবং ইতালির আবদুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসটিপি)-এর রেগুলার অ্যাসোসিয়েট ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে উপাচার্য হিসেবে দেখতে চেয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে পোস্ট দিতে দেখা গেছে।
নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. রেজাউল করিমের নামও উপাচার্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
ড. রেজাউল করিম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের প্রধান, ডিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ইনিস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সেল (আইকিউএসি)-সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হাইয়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (হেকেপ)-এর অধীনে একটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্বব্যাংক পরিচালিত কলেজ এডুকেশন ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি)-এ কনসালটেন্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। গবেষণার পাশাপাশি আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে তিনি কনসালটেন্সি সেবা দিয়েছেন।
এরপর আলোচনায় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ড. হারুণ চৌধুরী ৩৫টির উপরে প্রকাশনা ও একাধিক পিয়ার রিভিউ কনফারেন্স পেপার প্রকাশ করেছেন।
অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ ২০০৯ সালে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স জুনিয়র ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স গোল্ড মেডেল পান। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের পরিবেশ বিশেষত সুন্দরবন নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সির অভিজ্ঞতা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, উপাচার্য হিসেবে তারা একজন্য যোগ্য ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকেই প্রত্যাশা করছেন। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য থেকেই প্রশাসনিকভাবে দক্ষ ও একাডেমিকভাবে বিশ্বমানের এমন কেউ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে আসুক এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ- উপাচার্যসহ প্রশাসনিক পদে দায়িত্বরতরা একের পর এক পদত্যাগ করতে থাকেন। তবে এ ঘটনায় ব্যতিক্রম ছিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করতে চাইলেও শিক্ষার্থীরা তা চায়নি। উপাচার্য পদত্যাগ করবে, এমন খবর পেয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগ ঠেকাতে মিছিল করে। এমন ব্যতিক্রম দৃশ্য অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়নি।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, তিনি আওয়ামী লীগের নমিনেশনে উপাচার্য হলেও তার একাডেমিক তথা গবেষণা ও প্রশাসনিক দক্ষতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে মূখ্য ভূমিকা রেখেছে। তাই সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের ভিসি হিসেবে নিয়োগের পক্ষে মত দেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।