মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

পুঁজিবাজার নিয়ে আশাবাদী অর্থ উপদেষ্টা, হতাশ বিনিয়োগকারীরা

আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০০

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেয়ার বাজারকে শক্তিশালী করতে চায় জানিয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, শেয়ার বাজারে সংস্কার হচ্ছে। সব সংস্কারেরই কিছু যন্ত্রণা থাকে। তাই শেয়ার বাজারের সংস্কার কার্যক্রমের এই যন্ত্রণা সাময়িকভাবে সইতে হবে। দেশের শেয়ার বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর নিকুঞ্জস্থ ডিএসই ভবনে গতকাল মঙ্গলবার এই আলোচনাসভার আয়োজন করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এদিকে গতকাল যখন অর্থ উপদেষ্টা শেয়ার বাজারের উন্নয়নে বাজারের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন ডিএসইর সামনে বাজারের মন্দাবস্থা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা মানববন্ধন করেন।

বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, বিগত সময়ে নানা অনিয়ম, কারসাজি পুঁজিবাজারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। গত দেড় দশকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্ধেকই এখন রুগ্ন। এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে গেছে। শ্বেতপত্র কমিটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, শেয়ার বাজার থেকে গত দেড় দশকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান করে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠন করা হলেও বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। উলটো টানা দরপতনে বাজার নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। এ পরিস্থিতিতে অর্থ উপদেষ্টা গতকাল শেয়ার বাজারের উন্নয়নে করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক স্টেকহোল্ডার বলেছেন, প্রণোদনা দিয়ে হলেও পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানি আনতে হবে। এজন্য করের সুবিধাসহ সরকারি যেসব নীতিসহায়তা দরকার, সেসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে। তারা বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে আকর্ষণীয় কোনো প্রডাক্ট নেই। যে প্রডাক্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে প্রবেশ করলে তার লোকসান হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।

বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ভালো ভালো কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে আসতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। এসব কোম্পানির মালিকেরা ভাবেন, ছেলে হবে পরিচালক, বউ চেয়ারম্যান। ব্যবসায় যা মুনাফা হবে, তা নিজেরা ভোগ করবেন। কিন্তু সময় এসেছে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর। তাই ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। এজন্য করের সুবিধাসহ সরকারি যেসব নীতিসহায়তা দরকার, সেসব বিষয় বিবেচনা করা হবে।

সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের ঋণনির্ভর অর্থনীতি টেকসই কোনো অর্থনীতি নয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শিল্প গড়লে অনেক সময় টাকা ফেরত না দিলেও চলে। এ কারণে আমাদের দেশে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বেশি। দেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়েরও বড় সমস্যা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভুল নীতির কারণেও শেয়ার বাজারে সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মধ্যে সমন্বয় বা যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। শেয়ার বাজারের স্বার্থে এই যোগাযোগ ও সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি দলগতভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাজার-সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। অর্থ উপদেষ্টা পুঁজিবাজারে প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বাজার-সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ), বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল), সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও ফাইনান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

গতকালের বৈঠক প্রসঙ্গে সরকারের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ ইত্তেফাককে বলেন, সরকার দীর্ঘ মেয়াদে বাজার ভালো করতে সংস্কার কাজ করছে। তবে ভালো কোম্পানি না আনতে পারলে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না।

বৈঠক প্রসঙ্গে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ইত্তেফাককে বলেন, বৈঠকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানিয়েছে, তারা বাজারে আর কোনো নিম্নমানের আইপিও আনবে না। আমরা আশা করব, বর্তমান কমিশন পূর্বের ভুলগুলো আর করবে না। সেই সঙ্গে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কিংবা বিএসইসি স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো কাজে অযথা হস্তক্ষেপ করবে না।

বিনিয়োগকারীদের মানববন্ধন:এদিকে ডিএসইর সামনে পুঁজিবাজারের বর্তমান মন্দাবস্থা নিয়ে মানববন্ধন করেন বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে এই মানববন্ধনে তারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনে তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। প্রতিদিন শেয়ার ফোর্সড সেলের কারণে কোনো না কোনো বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদেরকে বাঁচাতে তারা অর্থ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ সময় সংগঠনটির মুখপাত্র নুরুল ইসলাম মানিক ইত্তেফাককে বলেন, মানববন্ধন চলাকালে অর্থ উপদেষ্টা বার্তাবাহক পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে বৈঠক করতে চেয়েছেন। আগামীকাল (আজ বুধবার) অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করতে যাবেন বলে তিনি জানান।

ইত্তেফাক/এমএএম
 
unib