শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৪ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

কর্মবিরতিতে অনড় রানিং স্টাফরা

দেশ জুড়ে ট্রেন বন্ধে ভোগান্তিতে যাত্রীরা 

  • দাবি পূরণে আলোচনা চলছে: রেল উপদেষ্টা
  • আন্দোলনের বিষয়টি একান্তই নিজস্ব: অর্থ উপদেষ্টা 
  • ময়মনসিংহে ট্রেন রেখে পালিয়ে যান চালক
  • বিআরটিসি বাস দিয়ে যাত্রী পরিবহনের ব্যর্থ চেষ্টা
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০

পূর্বঘোষণা ছাড়াই রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতিতে সারা দেশে ট্রেনের যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে দিনভর কাটাতে হয়েছে। সারা দেশে রেলের নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সোমবার রাত ১২টার পর কর্মবিরতিতে গেলেও মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেনগুলো দাঁড়িয়ে যায়। যাত্রীরা সকালে স্টেশনে এসে জানতে পারেন ধর্মঘট চলছে। এ অবস্থায় তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। কীভাবে গন্তব্যে যাবেন, টিকিটের টাকা ফেরত হবে কীভাবে, এমন নানা চিন্তা নিয়ে হাজার হাজার যাত্রীকে স্টেশনগুলোতে পরিবার নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন, বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, ময়মনসিংহ, পঞ্চগড়, রংপুর, লালমনিরহাট, যশোর, কক্সবাজার, পার্বতীপুর, জামালপুর, ঈশ্বরদী, গাইবান্ধা, নোয়াখালী, শান্তাহারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে শত শত যাত্রী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর মধ্যে রাজশাহী স্টেশনে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা বিশ্রামাগারের চেয়ার ও জানালা ভাঙচুর করে। চট্টগ্রামে যাত্রীদের বিক্ষোভ করতে দেখা যায়।

অন্যদিকে, যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘব করতে রেল কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করে। কমলাপুর স্টেশন ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে বিআরটিসি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ও দোতলা বাস অপেক্ষা করতে দেখা যায়। টিকিটধারী যাত্রীদের ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসব বাস স্টেশনের সামনে রাখা হয়। তবে বিআরটিসি বাসে খুব কম সংখ্যক যাত্রী ভ্রমণ করেছেন। বেশির ভাগ যাত্রী স্টেশন থেকে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ড ও বাস টার্মিনালে যান। কিন্তু ট্রেন বন্ধের সুযোগে বাসের টিকিট দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়েছে। যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিয়ে টিকিট কেটে বাসে তাদের গন্তব্যে গেছেন।

রানিং স্টাফদের আন্দোলন: আন্দোলনরত রানিং স্টাফদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেও কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। রানিং স্টাফ নেতারা বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা আরও আলোচনা করবেন, তবে কর্মবিরতিও চলবে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির ঢাকা বিভাগীয় কমিটির সভাপতি সাঈদুর রহমান।

উল্লেখ্য, মূল বেতনের সঙ্গে রানিং অ্যালাউন্স যোগ করে পেনশন এবং আনুতোষিকের দাবি পূরণ না হওয়ায় সোমবার মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির এই কর্মবিরতি শুরু হয়। ফলে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

সচিবের সঙ্গে বৈঠক: এ সমস্যার সমাধানে আন্দোলনরত রানিং স্টাফদের নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বৈঠকে বসেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মো. ফাহিমুল ইসলাম। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে ঐ বৈঠক শুরু হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে বেলা ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেরিয়ে আসেন রানিং স্টাফ প্রতিনিধিরা।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ঢাকা বিভাগীয় কমিটির কার্যকরী সভাপতি মো. সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দীর্ঘক্ষণ রেল সচিব ও মহাপরিচালকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারিনি বলে চলে এসেছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। তবে আমরা আমাদের কর্মবিরতিতে অনড় আছি।’ পরে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে রেলসচিব ফাহিমুল ইসলামকেও স্টেশন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। যাওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘রেলভবনে আরেক দফা বৈঠক হবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।’

রেলের রানিং স্টাফদের দাবি পূরণে আলোচনা: রেলের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘দাবি পূরণে অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’ গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেল স্টেশনে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘দাবি থাকতে পারে। কিন্তু ট্রেন বন্ধ রেখে যাত্রীদের জিম্মি করে আন্দোলন দুঃখজনক। এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হাতে কিছু নেই, যা করার অর্থ মন্ত্রণালয়কে করতে হবে। আলোচনা চলছে, সমাধান হবে।’

আন্দোলনের বিষয়টি একান্তই নিজস্ব: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, রেলের কর্মচারীদের কিছু দাবি ছিল, আমরা বেশ কয়েক দিন আগেই তাদের সুবিধা দিয়েছি। তার পরও তারা এখন কেন আন্দোলন করছে, এটা তাদের ব্যাপার। গতকাল সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের যা দেওয়ার দিয়েছি এখন অন্যান্য দাবি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখবে। যৌক্তিক কিছু থাকলে অর্থ মন্ত্রণালয় মানা করবে না। মানবিক কারণে বা মানুষের চাকরির ব্যাপারে সমস্যা হলে সে বিষয়েও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘রেলের ওভারটাইমের ইস্যুটি এসেছিল, সেটা আমরা সমাধান করেছি। এখন যদি বলে পেনশন গ্র্যাচুইটি যোগ করতে হবে, এমন দাবি তো অন্যান্য সংস্থার অনেক আছে। দাবির ইস্যুতে তারা যদি রেল বন্ধ করে দেয় তাহলে সে বিষয় রেলওয়ে উপদেষ্টা বলবেন।’

রানিং স্টাফদের মাইলেজ সমস্যা: রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী একজন রানিং স্টাফ (চালক, সহকারী চালক, গার্ড, টিকিট চেকার) ট্রেনে দায়িত্ব পালন শেষে তার নিয়োগপ্রাপ্ত এলাকায় হলে ১২ ঘণ্টা এবং এলাকার বাইরে হলে আট ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। রেলওয়ের স্বার্থে কোনো রানিং স্টাফকে তার বিশ্রামের সময় কাজে যুক্ত করলে বাড়তি ভাতা-সুবিধা দেওয়া হয়; যা রেলওয়েতে ‘মাইলেজ’ সুবিধা হিসেবে পরিচিত। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয় মাইলেজ সুবিধা সীমিত করতে রেল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। ঐ চিঠিতে আনলিমিটেড মাইলেজ সুবিধা বাদ দিয়ে তা সর্বোচ্চ ৩০ কর্মদিবসের সমপরিমাণ করার কথা জানানো হয়। এছাড়া বেসামরিক কর্মচারী হিসেবে রানিং স্টাফদের পেনশন ও আনুতোষিক ভাতায় মূল বেতনের সঙ্গে পাওয়া কোনো ভাতা যোগ করার বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। এরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রানিং স্টাফরা।

টিকিট ফেরত দেবে রেল: কমলাপুর স্টেশনের ম্যানেজার শাহাদাত হোসেন জানিয়েছেন, আন্দোলনের কারণে মধ্যরাত থেকে সারা দেশে বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। ফলে যেসব ট্রেনের যাত্রা বাতিল হবে সেসব ট্রেনের টিকিটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

ময়মনসিংহে ট্রেন রেখে চালক পলাতক: ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তঃনগর হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনটি পাঁচ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে রেখে পালিয়েছেন চালক। এতে বিক্ষুব্ধ যাত্রীরা স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট নাজমুল হক খানকে অবরুদ্ধ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

ইত্তেফাক/এমএএম
 
unib