শুক্রবার, ২৮ মার্চ ২০২৫, ১৪ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

ঈদের আগে সব বই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা

বাজারে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০

চলতি শিক্ষাবর্ষের এক মাস চার দিন অতিবাহিত হয়েছে। এখনো বিনা মূল্যের প্রায় ১৮ পাঠ্যবই ছাপানো হয়নি। সব শিক্ষার্থীর হাতে পাঠ্যবই না পৌঁছালেও বাজারে গাইড বইয়ের ছড়াছড়ি। গত ১৫ বছর ধরে অবৈধ গাইড বইয়ের রমরমা বাণিজ্য করে আসছে লেকচার, পাঞ্জেরী, এডভান্সড, পপি, অনুপম, জননী, জুপিটারসহ ৫০টি পাবলিকেশন্স। এদের অধিকাংশই বরাবরের মতো এবারও পাঠ্যবই ছাপানোর কাজও পেয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্দেশনা উপেক্ষা করে পাঠ্যবইকে গুরুত্ব না দিয়ে গাইড বই ছাপানোর কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন করে বাজারে তা সরবরাহ করেছে। ‘একের ভেতর সব’ শিরোনামে খোলস পালটে অবৈধ গাইড বইয়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘সহায়ক বই’, ‘অনুশীলন মূলক বই’। 

গতকাল সরেজমিন রাজধানীর নীলক্ষেত, বাংলাবাজার ও মিরপুর-১০ নম্বর বই বাজারে ঘুরে দেখা যায়, দোকানে দোকানে গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। এনসিটিবির ওপর আস্থা হারিয়ে অনেক অভিভাবক চড়া দামে গাইড বই ও পাঠ্যবই ক্রয় করছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছায় গাইড বই বিক্রি বেশি হচ্ছে। গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেন, গাইড বইয়ের কারণে মুখস্থ নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। মেধার বিকাশ হচ্ছে না।

প্রাথমিক ও  মাধ্যমিকে এবার মোট শিক্ষার্থী ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন। ৪০ কোটি, ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি বই প্রয়োজন। তবে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২২ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো ও সরবরাহ করা হয়েছে বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে। এখনো ১৮ কোটি ১৫ লাখ পাঠ্যবই ছাপানো প্রয়োজন। এখনো সব শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পায়নি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পেয়েছে আংশিক বই। কাগজ সংকট না থাকলে দিনে ৪০ লাখ পাঠ্যবই ছাপানোর সক্ষমতা রয়েছে দেশের ১১৬টি ছাপাখানার। কিন্তু গত দুই মাস ধরে কাগজের কৃত্রিম সংকট চলছে। প্রতি টন কাগজের মূল্যও বাড়ানো হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। এ কারণে বই ছাপাতে দেরি হচ্ছে। ছাপাখানার মালিকরা বলেন, গত দুই মাস ধরে প্রতি দিনই ২০ লাখ কপি কম ছাপাতে হচ্ছে কাগজ সংকটের কারণে। এ কারণে ঈদের আগে সব বই ছাপানো হয়তো সম্ভব হবে না। রাজধানীর নীলক্ষেত ও বাংলাবাজারে মাধ্যমিকের প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যবই সেট ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রাথমিকের প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যবই সেট বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। নীলক্ষেতে পাঠ্যবই কিনতে আসা আরিফুর রহমান বলেন, তার মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বই এখনো মেলেনি। এদিকে স্কুলে ক্লাস ও প্রাইভেট শুরু হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে গাইড বই কেনেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণির একের ভেতর সব গাইড বইয়ের দাম রাখা হচ্ছে ৭৩০ থেকে ৮০০ টাকা। এগুলো আলাদা আলাদাভাবে কিনলে লাগছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা।

সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। নিষিদ্ধ এসব বই ছাপা বন্ধ করতে এবার ডিসিদের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা জেলা প্রশাসককে পাঠানো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই ছাপা পুরো জানুয়ারি জুড়ে চলবে। এ সময়ে ৪০ কোটি পাঠ্যবই ছাপার কাজে নিযুক্ত প্রেসসমূহে যেন নোট ও গাইড বই, ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপতে না পারে তা নিশ্চিত করতে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বলা হলো। চিঠিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে ১১৬টি প্রেসের ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েক জন জেলা প্রশাসককে একই চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর আগে গত ৩ ডিসেম্বর প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম ও সমমান শ্রেণির বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর আগে সব ধরনের সহায়ক বই বা নোট-গাইড ছাপা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় এনসিটিবি।

সৃজনশীল মেধা বিকাশ নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইডও নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। তার পরও গত ১৩ বছর দুর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে কয়েকটি ছাপাখানার মালিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সকল শ্রেণির ‘একের ভেতর সব’ নাম দিয়ে তৈরি গাইড-সহায়ক বই ছাপিয়ে প্রকাশ্যে বাজারজাত ও বিক্রি করেছে।

১৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মান :জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) গণঅভ্যুত্থানের পর ঢেলে সাজানো হয়েছে। পরিমার্জনের পর পাঠ্যবই ছাপানোর ক্ষেত্রে অল্প সময় পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের সময়ে তৈরি হওয়া অসাধু চক্র এবার বই ছাপাতে অসহযোগিতা করায় কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। সরকার আশা করে চলতি মাসেই সব বই ছাপা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। এদিকে বই দিতে দেরি হলেও মান নিয়ে এবার আর কোনো প্রশ্ন নেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ মানের বই সরবরাহ করা হচ্ছে। এ বছর এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের বই তদারকির দায়িত্ব পেয়েছে ‘ব্যুরো ভেরিটাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ‘ব্যুরো ভেরিটাসে’র ডেপুটি ম্যানেজার আফজাল কবির গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এবার পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই। এনসিটিবি নির্ধারিত মান বজায় রাখতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন অধ্যাপক ইত্তেফাককে বলেন, গাইড বইয়ে বাধ্য করে শিক্ষার্থীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যার দিকে। তাদের সৃজনশীলতা ধ্বংস করা হচ্ছে। মেধা খাটিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রশ্নের উত্তর ও অন্যান্য বিষয় জানার চেষ্টা করার মধ্যে শিক্ষার্থীকে যে চিন্তা ও মনোযোগ দিতে হয়, তাতে তাদের মেধা বিকাশের পথ খুলে যায়। কিন্তু ভুলভ্রান্তিতে ভরা নোট ও গাইড বইয়ে সবকিছু থরে থরে সাজানো থাকায় শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত বিকাশ হয় না।

ইত্তেফাক/এমএএম
 
unib