সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫, ৯ চৈত্র ১৪৩১
The Daily Ittefaq

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল

পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ চলে যাচ্ছে বিদেশীদের হাতে

আগের সরকারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের ওপর চলছে কাজ

আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৬

গতবছরের ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাবেক নৌ-পরিবহন মন্ত্রীসহ অনেকে দেশ ছেড়ে গেছেন। কিন্তু তাদের নেয়া বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর ওপর এখনো কাজ চলছে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন সরকার চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার কাজ বিদেশীদের হাতে দিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেসময়কার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার তদবিরের মাধ্যমে টার্মিনালটি দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কোনপ্রকার দরপত্র ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত টার্মিনালটি বিদেশীদের হাতে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্তে হতবিহবল হয়ে পড়েন বন্দর ব্যবহারকারী এবং দেশীয় বিনিয়োগকারীরা। তাদের যুক্তি হচ্ছে বিদেশী কোম্পানি বন্দরের নতুন কোন টার্মিনাল তৈরী করার কাজে বিনিয়োগ করুক। বন্দরের তৈরী করা টার্মিনালটি পরিচালনা করে মূলত: বিদেশী কোম্পানি অর্জিত মুনাফার মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে নিয়ে যাবে। আর এই টার্মিনা পরিচালনায় দেশীয় কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা রয়েছে।

জানা গেছে, দুবাইভিত্তিক কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড বিগত সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দরে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছিলো। সে বিনিয়োগ ছিলো প্রস্তাবিত বে-টার্মিনালকে ঘিরে। কিন্তু পরবর্তীতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ডিপি ওয়ার্ল্ড এনসিটি টার্মিনালটি চেয়ে বসে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) অথরিটির প্রচেষ্টায় সে কার্যক্রম এগিয়ে যেতে থাকে। বিগত সরকার ক্ষমতা থেকে চলে গেলেও প্রধান উপদেষ্টার অফিসের একজন বিশেষ দূত প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এর নিজস্ব অর্থায়নে এনসিটি নির্মাণ করা হয়। নানা সময়ে টার্মিনালটিতে বন্দরের মোট ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ২০০৭ সালে এটি চালু হওয়ার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ ি অর্থায়নে যন্ত্রপাতিও কেনে। বর্তমানে এনসিটিতে ১৪টি রেল মাউটেন্ট কী গ্যান্ট্রি কেন (কিউজিসি) এবং ২৯টি রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি) সংযুক্ত হয়েছে। এছাড়া, এনসিটি হতে বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ কার্গো হ্যান্ডলিং করে বছরে এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে চট্টগ্রাম বন্দর। পিপিপি'র মাধ্যমে এনসিটি বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হলে বন্দরের নিজস্ব বিনিয়োগের পুরোটাই চলে যাবে বিদেশীদের হাতে। তার আগে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পাতলা টার্মিনালটিও সৌদি আরবের রেড সি কোম্পানির হাতে তুলে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট মহল জানিয়েছে, এনসিটিকে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে নিতে এখনো তৎপর একটি চক্র। চট্টগ্রাম বন্দরের তৈরী করা স্থাপনাগুলোতে এই মুহুর্তে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই এমন কথাও জানিয়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এরপরও থেমে নেই এই চরের কাজ। বন্দর খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দরের মতো এরকম একটি অত্যাবশ্যকীয় সেবা বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য যেমন হুমকি হবে সঙ্গে সঙ্গে দেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাবে। বিশেষ করে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে যখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাচানোর চেষ্টা চলছে সেসময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক দেশ তাদের বন্দরগুলো চালানোর জন্য বিদেশী কোম্পানি নিয়োগ দিলেও পরবর্তীকালে তাদেরকে সেখান থেকে বিদায় করা হয়েছে। 

উল্লেখ্য, এনসিটি পরিচালনার জন্য বিগত সরকার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক একটি বিদেশি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে মতামত চায়। চট্টগ্রাম বন্দর তাদের জবাবে বলেছে, এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। তারপরও সর্বোপরি এটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। জানা গেছে, বন্দরের এমন মন্তব্যের পরও আওয়ামী লীগ সরকার ওই বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে থাকে। মূলত: তৎকালীন সরকারের বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ব্যক্তিগত আগ্রহে মন্ত্রণালয় এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনার কার্যক্রম দিতে মরিয়া হয়।

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালে বিদেশি কোষ্কানি নিয়োগ করা হলে তা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। বিশেষ করে টার্মিনালগুলোর আশপাশে নৌ এবং বিমানঘাঁটি থাকায় এ বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে বলে তারা জানান। এছাড়া বিদেশি কোম্পানিগুলো স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকার মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাবে, যা এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি। বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং এর কাজ বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য এক অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলো তৎকালীন সরকার। এক্ষেত্রের জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি (ডিপিএম) অনুসরণ করেছে সরকার। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ (পিপিপি) পদ্ধতির নাম করে কোন প্রকার দরপত্র ছাড়াই কাজটি এখনো এগিয়ে নিচ্ছে সরকার।

উল্লেখ্য, এর আগে বিনা দরপত্রে বন্দরের নতুন পতেংগা কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশী কোম্পানিকে দিয়ে দেয়া হয়। কোন প্রকার দরপত্র ছাড়া যাতে প্রকল্পগুলো হস্তান্তর করা যায় সেজন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ বা পিপিপি অথরিটি তৈরী করা হয়। বন্দরের অন্যতম আরেকটি আধুনিক টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালকেও (এনসিটি) বিদেশীদের হাতে আগের কায়দায় তুলে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পিপিপি অথরিটিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো যত দ্রুত সম্ভব টার্মিনালটিকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করার। ৫ আগষ্টের পর নতুন সরকার আসলে বিষয়টি স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একজন বিশেষ দূতের আগ্রহে কাজটি আবার শুরু করেছে পিপিপি অথরিটি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। উদ্যোক্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পিপিপি অথরিটি তৈরী করা হয়েছিলো পছন্দসই কোম্পানিগুলোতে বিনা দরপত্রে কাজ দেয়ার জন্য। মূলত: বিদেশী কোম্পানিগুলোকে এসব কাজ দেয়া হলেও এর পেছনে থাকতো স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র। সে ধারাবাহিকতা চলছে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে

ইত্তেফাক/এনএন
 
unib