ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি লুৎফুল্লাহেল মাজেদকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে আয়ানাঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল। উল্টো করে তাকে নির্যাতনের পর পানি চাইলে প্রস্রাব খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল গুমকারীরা। সম্প্রতি গুম সংক্রান্ত কমিশনে দেওয়া এক অভিযোগে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মাজেদ এভিয়েশন খাতের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এরোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। বিএনপির ময়মনসিংহ জেলার সহসভাপতি হলেও আগে দায়িত্ব পালন করেছেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি পদে। গত বছরের জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে তার ওপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর নির্যাতন।
অস্ত্রধারীরা তাকে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার পর ৬ দিন ছিলেন নিখোঁজ। পুরো সময়ে তার চোখে বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন, পানি চাইলে প্রস্তাব দেওয়া হয় প্রস্রাব খাওয়ার। এক পর্যায়ে তাকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হলেও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দিন তিনি মুক্তি পান।
গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে দুই পাতার একটি অভিযোগ দিয়েছেন মাজেদ। তাতে উঠে আসে গুমের পর নির্মম নির্যাতনের চিত্র। গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে জমা দেওয়া অভিযোগে মাজেদ উল্লেখ করেন, 'তিনি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা পতনের আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।'
অভিযোগে বলা হয়, টানা ৬ দিন ধরে তার (মাজেদ) চোখ বেঁধে, উল্টো করে টানিয়ে বর্বর নির্যাতন চালানো হয়। পানি চাইলে তাকে প্রস্রাব পর্যন্ত খাওয়ার কথা বলা হয়। জানতে চাওয়া হয়, তিনি আন্দোলনে কতো টাকা খরচ করেছেন। লন্ডন থেকে তারেক রহমান কতো টাকা পাঠিয়েছেন। এসব প্রশ্নের জবাব না দেওয়ায় তাকে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে গুম করার জন্য উপরের নির্দেশনা রয়েছে বলে হুমকি দেওয়া হয়।
অভিযোগে আরও বলা হয়, 'আয়নাঘরে চোখ বেঁধে নির্যাতনকারীরা আমার কাছে জানতে চায়, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের প্রজেক্ট নিয়ে রিট করেছিস কেন? বুঝতে পারি যে, সিটিটিসির প্রধান আসাদুজ্জামান আমাকে আয়নাঘরে কেন বন্দি রেখেছেন? নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক জবাব না পেয়ে আমাকে ৩ আগস্ট আয়ানঘরে চোখ খোলা হয়। পরের দিন মিথ্যা মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। হাসিনার পতনের পর আমি ৬ আগস্ট মুক্তি পাই।'
লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বলেন, ২৮ জুলাই রাতে তাকে রাজধানীর গুলশানের বাসা থেকে সাদা পোশাকের অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা তুলে নেয়। বাসার নিচে গাড়িতে তোলার আগে জমটুপি পরিয়ে দেওয়া হয়। গাড়িতে বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে ওই রাতে তাকে একটি ভবনে নেওয়া হয়।
তিনি বলেন, নির্যাতনের সময়ে তাকে বারবার জিজ্ঞাস করা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার মাধ্যমে কাতো টাকা দিয়েছে, তাদের পরিকল্পনা কি এবং আন্দোলনের সমন্বয়কদের মিটিং হয় কোথায়? তোর হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ থেকে কাকে কতো টাকা দিসিস সব পেয়েছি আমরা।
মাজেদ এসব বিষয়ে মুখ না খোলায় তার ওপর নির্যাতনের মাত্র বেড়ে যায়। চোখ বাঁধা অবস্থায় একজন জানতে চান, প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন) শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে তার ঝামেলা কি নিয়ে? অজ্ঞাতপরিচয়ে ওই লোকজনের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে আন্দোলন দমাতে গুম করা হয়েছে।
মাজেদের স্বজনরা জানান, ওই রাতে বাসার ভেতর অস্ত্রধারীদের তান্ডবে মাজেদের দুই শিশু সন্তান আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এখনও তাদের ভেতর ট্রমা কাজ করছে। লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বলেন, হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে গুম হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। এভিয়েশন খাতে একটি চক্র তাদের লুটপাট আড়াল করতেই ষড়যন্ত্র করে তাকে নানাভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে।