শিক্ষক সংকট, ছাত্রাবাসের অভাব, ক্যান্টিন, মিলনায়তন ও বিশুদ্ধ পানির সংকট, সীমানা প্রাচীর সহ নানান সমস্যায় জর্জরিত সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শাল্লা উপজেলার একমাত্র কলেজ শাল্লা সরকারি ডিগ্রি কলেজ। ১৯৮৬ সালে ১লা অক্টোবর শাল্লা কলেজ ৭ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে ৩০ জন শিক্ষার্থী ও ৪ জন শিক্ষক নিয়ে কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়।
২০১৮ সালের ৮ আগস্ট কলেজটি জাতীয়করণ হয় এবং উচ্চ মাধ্যমিকের পাশাপাশি স্নাতকে (ডিগ্রি) উন্নতি লাভ করে। বর্তমানে কলেজে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ১হাজার ৬'শ জন হলেও শিক্ষকের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কমে এখন ১৫ জনে দাঁড়িয়েছে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত রেজাল্টের দিক দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলায় একটানা শাল্লা কলেজ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ও সরজমিনে পরিদর্শন করে এসব জানাযায়।
শিক্ষক-সংকটে পাঠদান ব্যাহত:
কলেজে প্রায় ১হাজার ৬'শ শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৫ জন। যদিও এ শিক্ষকের পদসংখ্যা অনেক আগের নির্ধারণ করা। এখন শিক্ষার্থী বেড়েছে অনেক গুণ। তাই পদসংখ্যা আরও বাড়ানোর দাবি চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। বর্তমানে কলেজটিতে উচ্চ মাধ্যমিকে (এইচএসসি) একাউন্ট, ম্যানেজমেন্ট, যুক্তিবিদ্যা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ১ জন করে শিক্ষকের প্রয়োজন কিন্তু নেই কোন শিক্ষক। অন্যদিকে স্নাতকে (ডিগ্রি) বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে ১ জন করে শিক্ষকের জায়গায় কোন শিক্ষক নেই। বিজ্ঞান বিভাগে ডেমোস্ট্র্যাটার (প্রদর্শক) ৪ জন ও ল্যাব এসিস্ট্যান্ট ১ জনের মধ্যে সবগুলো পদ এখনও শূন্য। জাতীয়করণের পর কলেজে কোন শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। বিশেষ করে কমার্স (বাণিজ্যিক) বিভাগের কোন শিক্ষক না থাকায় পাঠদান স্থবির হয়ে পড়েছে। আবার ২০২৬ সালের মধ্যে অধ্যক্ষ সহ ৩ জন শিক্ষক অবসর গ্রহণ করবেন৷
কর্মকর্তা-কর্মচারী সংকট:
কলেজে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাও চাহিদার চেয়ে অনেক কম। অফিস সহকারী ৩ জনের মধ্যে নেই একজনও। আপাতত ৩ জন খণ্ডকালীন লোক দিয়ে অফিসিয়াল কাজ পরিচালিত হচ্ছে। অন্যদিকে অফিস সহায়ক ৪ জনের মধ্যে ২ জন এবং আয়া ২ জনের মধ্যে রয়েছে ১ জন। নেই কোন নাইটগার্ড ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট:
শাল্লা কলেজে মেয়েদের কোন হোস্টেল নেই। একটা হোস্টেলের বিল্ডিং নির্মাণে পিলারের কাজ কমপ্লিট হলেও পরে অদৃশ্য কারণে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ছেলেদের জন্য একটি ছাত্রাবাস থাকলেও সেটি বসবাস করার অনুপযোগী। ছাত্রাবাসের অভাবে অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত পাঠদান করতে পারছে না।
কলেজের সীমানাপ্রাচীর নেই:
কলেজ প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরেও সীমানা প্রাচীর (বাউন্ডারি) নির্মাণ হয়নি। এই বাউন্ডারি ওয়াল না থাকায় বহিরাগতদের আড্ডা প্রতিনিয়ত হয় কলেজ চলাকালীন ও রাতের বেলা। এছাড়াও গরু ছাগল অবাধে বিচরণ করে থাকে। এতে করে সমস্যা পোহাতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
ক্যান্টিন ও মিলনায়তন সংকট:
কলেজে শিক্ষার্থীদের সাময়িক ক্ষুধা নিবারণের জন্য কোন ক্যান্টিন নেই। কলেজের হাফ টাইমে শিক্ষার্থীরা খাবারের প্রয়োজনে বাজারে আসতে হয়। এবং শিক্ষার্থীদের কোন মিলনায়তন নেই। যদিও মিলনায়তনের জন্য অস্থায়ীভাবে ক্লাস রুম ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
বিশুদ্ধ পানির সংকট:
উপজেলার একমাত্র সরকারি কলেজের মধ্যে দুটি টিউবওয়েল রয়েছে এরমধ্যে একটি অকেজো। বাকী একটি টিউবওয়েল কলেজের শিক্ষকদের আবাসিক ভবন সংলগ্ন। সেখানে শিক্ষার্থীদের পানি পান করতে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
শিক্ষার্থী কায়েস চৌধুরী ও রাকিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, আমাদের এই কলেজ বিভিন্ন সমস্যায় পতিত। যেমন শিক্ষকের অভাব, শিক্ষার্থীদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক না থাকায় বিভিন্ন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পারছে না। ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্য আবাসিকের ব্যবস্থা নেই। খাবারের জন্য কোন ক্যান্টিন ও বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা একটা নলকূপ প্রয়োজন। কলেজের বাউন্ডারি দেওয়া অতীব জরুরী যাতে বহিরাগত মানুষ ও কোন প্রাণী ঢুকতে না পারে। শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা মিলনায়তনে প্রয়োজন।
এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বলেন, কলেজের দুটো ভবনের বাথরুম যেগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষার্থীদের ব্যাঘাত ঘটছে পড়াশোনায়। প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও সমাধান হচ্ছে না বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
এইচএসসি শিক্ষার্থী তাহমিন আক্তার ও জুই চৌধুরী বলেন, আমাদের কলেজে বাউন্ডারি না থাকায় যেকোনো সময় বাহির থেকে মানুষ ঢুকে পড়ে। এতে আমাদের একাডেমিক সমস্যা হয়। কলেজ থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে তাই নিয়মিত ক্লাস করতে পারছি না। যদি কলেজে হোস্টেল নির্মাণ হত তাহলে অনেকেই এখানে থাকতে পারত। আমাদের ক্লাস করতে সমস্যা হতো না। কলেজে একটা ক্যান্টিন দরকার আমরা ক্লাসের ফাঁকে সাময়িক ক্ষুধা নিভৃত করতে পারতাম।
জীববিজ্ঞানের শিক্ষিকা শিল্পী ভৌমিক ও পৌরনীতিও সুশাসন বিভাগের শিক্ষিকা (খন্ডকালীন) তমা আক্তার বলেন, কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাউন্ডারি নেই। যার কারণে বাহিরে থেকে মানুষ ইচ্ছে স্বাধীন চলাফেরা করে। এতে আমাদের সমস্যা হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা উন্নয়নের লক্ষ্যে অতিদ্রুত ছাত্রী হোস্টেল গড়ে তোলা জরুরী। যেন শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে ও গার্ডিয়ানরা নিশ্চিন্তে তাদের পড়ালেখার সুন্দর পরিবেশ পায়।
গণিত বিভাগের শিক্ষক আরাধন সরকার ও ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এনামুল হক বলেন, এই কলেজ সরকারি হলেও শিক্ষকের অভাবে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে। মেয়ে শিক্ষার্থীরা কলেজে অবস্থান করার মতো কোনো ছাত্রীনিবাস নেই। যেও একটা ছেলেদের ছাত্রাবাস ছিল সেটাও পরিত্যক্ত। বাউন্ডারি অভাবে এই কলেজটি অরক্ষিত। ক্লাস চলাকালীন সময়ে কলেজের ভিতর আড্ডা বসে। এবং কলেজে একটি ক্যান্টিন থাকলে অল্প টাকায় শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষনিক ক্ষুধা নিভৃত করতে পারত। আমরা কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত প্রার্থনা জানাচ্ছি এই সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়াস চন্দ্র দাস বলেন, উপজেলার একমাত্র সরকারি কলেজ এটা দেখে আমি আশ্চর্য। শুনেছি কলেজে অনেক সমস্যা রয়েছে। আমরা অবস্থান থেকে কলেজের উন্নতির জন্য সমস্যা নিরসনে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ প্রতিবেদককে জানান, বহুদিন যাবত কলেজের শিক্ষক সংকট যার কারণে শিক্ষার্থী ও আমাদের জন্য খুব সমস্যা হয়। অফিসের সার্ভিসের জন্য কোন লোক নাই। খন্ডকালীন লোক দিয়ে অফিস চালানো হচ্ছে। সুরঞ্জিত সেন কলেজের ছাত্রনিবাস নির্মাণের জন্য পিলার করেছিলেন এটি এখনও খাড়া রয়েছে পরে আর কাজ হয়নি। ছাত্রাবাসের জন্য একটা ঘর থাকলে সেটি পরিত্যক্ত।
অধ্যক্ষ আরও বলেন, অনেক শিক্ষার্থী দূর-দূরান্ত থেকে এসে ক্লাস করে। তাদের হালকা খাবারের জন্য ক্যান্টিন নেই৷ খাবার পানির ও সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে বাউন্ডারি দিলে বহিরাগতরা কলেজের আঙ্গিনায় ঢুকতে পারবেনা। এবং আলাদা কোন মিলনায়তন নেই। সব মিলিয়ে আমাদের কলেজ অনেকটা সমস্যার মুখোমুখি। এইসব যাবতীয় সমস্যা নিরসনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানাব।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সিলেট অঞ্চলের সহকারী পরিচালক (কলেজ শাখা) প্রতাপ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, সদ্য সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট সমস্যার সমাধান শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আসতে হবে। ছাত্রাবাস ও বাউন্ডারি বিষয়টা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতাধীন। আর কিছু বিষয় স্থানীয়ভাবে সমাধান করা সুযোগ রয়েছে।