মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

রাজধানীতে অসহনীয় শব্দদূষণ

  • শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে মানুষ
  • হৃদপিন্ড ক্লান্ত করে, উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে
আপডেট : ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৬:০০

রাজধানীর বাসিন্দাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে শব্দদূষণ। ঢাকার উদ্বেগজনক এ দূষণের কারণগুলোর একটি যানবাহনের কোনো কারণ ছাড়াই হর্ন বাজানো। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর বড় সড়কগুলোতে গাড়ির হর্নের তীব্র নিনাদে মানুষের অবস্থা সঙ্গীন। যানবাহনের শব্দ, হর্নের শব্দ, এছাড়া ভবন নির্মাণের শব্দের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হর্ন বাজানো সম্ভবত আমাদের দেশের গাড়ি চালকদের একটা বদভ্যাস। ট্রাফিক সিগনাল বা জ্যামে আটকে থাকার সময়, ট্রাফিককে তাড়া দিতে কিংবা সামনে এগুনো যাবে না জেনেও ক্রমাগত হর্ন বাজান তারা। সামনে কেউ ধীর গতিতে চললে, পথচারীকে উদ্দেশ্য করে প্রতিনিয়ত হর্ন বাজান চালকরা। নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ির হর্নে রীতিমতো বধিরতার হার বেড়ে যাচ্ছে ঢাকায়। কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চাইতে আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি।

জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনএপি) আওতায় ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বিশ্বে শব্দ দূষণের প্রথম স্থানে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় অনুমতিযোগ্য শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকার শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল। শব্দ দূষণের এই অতিরিক্ত মাত্রা মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে যেমন নেই সচেতনতা, তেমনি নেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ফলে রাজধানীতে শব্দের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা সহনীয়মাত্রার চেয়ে কয়েকগুন বেশি। ফলে মানুষের শ্রবণশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। উচ্চ রক্ত চাপ, হৃদরোগ, অনিদ্রাসহ নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।   

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শব্দদূষণ রোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রবণক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। এজন্য আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে এবং অপ্রয়োজনীয় শব্দ সৃষ্টি করা হতে বিরত থাকতে হবে। তিনি বলেন, শ্রবণস্বাস্থ্য রক্ষা শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সম্প্রতি বিশ্ব শ্রবণ দিবস ২০২৫ এর আলোচনা সভায় উপদেষ্টা আরও বলেন, শব্দদূষণ শ্রবণক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। শহরাঞ্চলে অতিরিক্ত যানবাহনের হর্ন, শিল্পকারখানার শব্দ ও উচ্চস্বরে মাইক ব্যবহারের কারণে শ্রবণজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সরকার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, তবে নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, হর্ন বাজানো বন্ধ করা, সামাজিক অনুষ্ঠানসহ দৈনন্দিন কাজে বাহুল্য শব্দ সৃষ্টি বন্ধ করা জরুরি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, শব্দ দূষণের ক্ষতি দুই ধরনেরহয়—আমাদের শ্রবণ ইন্দ্রিয় বা কানের ক্ষতি করে। অন্যদিকে কান ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপরে চাপ বাড়ায়। বিশেষ করে হৃদপিন্ডের, ব্রেনের ক্ষতি হয়। এছাড়া শব্দ দূষণের ফলে আমাদের হৃদপিন্ডের গতি বেড়ে যায়; অর্থাৎ নাড়ির স্পন্দন বেড়ে যায়। এটি অনেক দিন থাকলে হার্টকে ক্লান্ত করে দেয়। ফলে হার্ট ফেউলিউর অবস্থা তৈরি হয়। অর্থাৎ হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া রক্তের চাপ বেড়ে যায়, উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হয়।

এই বিশেষজ্ঞ আরও জানান, শব্দ দূষণের কারণে আমাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের বিরক্তির ভাব তৈরি হয়। মাথা ঝিম ঝিম করে, মাথা ঘোরানোর অনুভূতি হয়। কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। খুব দ্রুত মানুষ রেগে যায় এবং একসময় দেখা যায় অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। ফলে সমাজে অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডোমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন. শব্দ দূষণ শ্রবনশক্তি হ্রাস করে, দেখা গেছে শব্দ দূষণের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে বাচ্চাদের বোঝার ক্ষমতা কমে যায়। আর একটি সমস্যা হচ্ছে মানসিক চাপ বাড়ছে। এই শব্দ দূষণের বেশি ক্ষতির শিকার হন বয়স্ক ও শিশুরা বলে জানান এই চিকিৎসক।

জাতীয় নাক কান গলা হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. আবুল হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, শব্দ দূষণ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে, আমাদের শ্রবনশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাবে। দীর্ঘ দিন শব্দের মধ্যে থাকলে আমাদের আউটার হেয়ার সেল ও ইনার হেয়ার সেল নষ্ট হতে থাকে। এছাড়া ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়। শব্দ দূষণের কারণে রাজধানীতে অনেক মানুষ কানে কম শুনতে পায়। বর্তমানে এসব রোগীর সংখ্যা বেশি হচ্ছে।

সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর রাজধানীর কিছু এলাকা ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করেছে। রাজধানীর শ্যামলী মোড় থেকে আগারগাঁও সড়কে ঢুকতেই চোখে পড়ে কিছু স্বেচ্ছাসেবক তরুণ জনসাধারণকে সচেতন করছে, হর্ণ বাজাতে নিষেধ করছে—প্লাকার্ড হাতে এবং হ্যান্ড মাইকে। কিন্তু মোটর বাইক, বাস, মাইক্রো বাসসহ বিভিন্ন যানবাহন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছেন। বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে বিধিমালা রয়েছে সেখানে বিস্তারিত বলা আছে—কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়ে, কোন ধরনের শব্দের মাত্রা কেমন হবে। আর তা না মেনে চললে সাজার বিধানও রয়েছে।

আইনে কি আছেঃ বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত নটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না; আবদ্ধ কোন স্থানে শব্দ করলে শব্দ যাতে বাইরে না যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ড্রিল মেশিনের ব্যবহার, অফিসের ডেকোরেশনে নিয়মিতই ভঙ্গ হচ্ছে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের বিধিমালা।

ইত্তেফাক/এমএএম